সুইস পার্ক

হারিয়েছে অনেক কিছু, তবু আছে আভিজাত্যের ছোঁয়া

যেমন ‘শিং নেই তবু নাম তার সিংহ’, তেমনই পার্ক নেই তবু এলাকার নাম সুইস পার্ক। নিজের পাড়া নিয়ে মজা করে হামেশাই এমনটা বলি।

Advertisement

দিলীপ রায়চৌধুরী

শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৬ ০২:৪৫
Share:

যেমন ‘শিং নেই তবু নাম তার সিংহ’, তেমনই পার্ক নেই তবু এলাকার নাম সুইস পার্ক। নিজের পাড়া নিয়ে মজা করে হামেশাই এমনটা বলি। পার্ক নাই-বা থাকল, তবু ঝাঁ-চকচকে বাড়ি, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে তৈরি হওয়া ঝলমলে দোকান আর উন্নত নাগরিক পরিষেবা ইঙ্গিত দেয়, আশপাশের পাড়ার তুলনায় আমাদের পাড়াটা বেশ অভিজাত হয়েছে। তা নিয়ে গর্ব করি বৈকি!

Advertisement

পাড়ার চৌহদ্দির মধ্যে রয়েছে পূর্ণচন্দ্র মিত্র লেন, পঙ্কজিনী চ্যাটার্জি লেন, চিন্ময় চ্যাটার্জি সরণি এবং প্রিন্স বখতিয়ার শাহ রোড। পাড়াটা রাজপথ থেকে কিছুটা ভিতরে, তাই শান্তিপূর্ণ। রাস্তা পার হলেই ভবানী সিনেমা হল আর টালিগঞ্জ ডাকঘর।

আমার জন্ম পূর্ববঙ্গের ফরিদপুরের গোপালগঞ্জে। দশ বছর বয়সে কলকাতায় আসা। তার পরে দু’এক বার বাড়ি পরিবর্তন করে থাকতাম কাছেই টালিগঞ্জ রোডে। যখন এ পাড়ায় বাড়ি করে এলাম, এখানকার মানুষ আপন করে নিয়েছিলেন। মনে হয়েছিল সকলেই কত পরিচিত। কেউ দূরে সরিয়ে রাখেননি। খুব জানতে ইচ্ছে করে, আজও পাড়ায় নতুন কেউ এলে পড়শিরা কি তাঁদেরও একই ভাবে আপন করে নেন?

Advertisement

উত্তর জানা নেই আমার। কারণ, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক পাল্টে গিয়েছে আমাদের পাড়াটা। বাইরের চাকচিক্য বাড়লেও কমেছে অন্তরের টান, মানুষে-মানুষে আন্তরিকতা, দেখা-সাক্ষাৎ আর যোগাযোগ। ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে কে কার খবর রাখেন। দেখা হলে কোনও মতে সৌজন্য বিনিময়। ব্যস, সেটুকুই।

পাড়ায় হাতে গোনা কয়েক জন পুরনো বাসিন্দার মধ্যে এখনও যোগাযোগটুকু আছে। তবে নতুনদের সঙ্গে যোগাযোগ খুব কম। এক পাড়ায় থেকেও অনেকেই অচেনা থেকে যান। তাঁরাও পুরনোদের সঙ্গে মিশতে চান না। কখনও কখনও মনে হয়, প্রত্যেকেই যেন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। নিজের জগতে ভাসমান, চারপাশে কী হচ্ছে তা নিয়ে কোনও ভাবনা-চিন্তা নেই।

সেই ৭০-এর দশকে যখন এসেছিলাম, তখন লোকজন ছিল কম। আশপাশে ছিল কিছু নির্মীয়মাণ বাড়ি ও প্রচুর গাছগাছালি। তবে এলাকাটা বরাবরই পরিচ্ছন্ন। সেই পাড়াতেই এখন যে দিকে চোখ যায়, শুধু বাড়ি আর বাড়ি। দমদম থেকে টালিগঞ্জ পর্যন্ত মেট্রো চলতে শুরু করার পরে এই অঞ্চলের অনেক উন্নতি হয়েছে। একটু একটু করে বেড়ে জমির দাম আজ আকাশছোঁয়া। যোগাযোগ ব্যবস্থাও খুব ভাল। কাছেই পাতাল রেল, টালিগঞ্জ রেল স্টেশন। এ ছাড়া পর্যাপ্ত অটো, বাস, ট্যাক্সি তো আছেই।

এ পাড়ায় আসার পরে দেখেছি, কেউ কারও বাড়ি গেলে আতিথেয়তার কোনও ত্রুটি রাখতেন না। সাধ্যমতো বাড়িতে তৈরি কিছু দিয়ে কিংবা দোকান থেকে এটা-ওটা আনিয়ে আন্তরিক ভাবে অতিথি আপ্যায়ন করতেন। কিন্তু, এখন সকলেই এত ব্যস্ত যে কেউ কারও বাড়িতে হঠাৎ গেলে বোধ হয় বিরক্তই হন। তার উপরে যদি তাঁদের সান্ধ্য বিনোদনে আকস্মিক বিঘ্ন ঘটে, তা হলে তো কথাই নেই!

হারিয়ে গিয়েছে পাড়ার জমাটি আড্ডাটা। এখন প্রবীণদেরও কম দেখা যায় আড্ডা দিতে। আড্ডাটাই ছিল বিনোদন। এখন হাজার বিনোদনের ভিড়ে আড্ডার সেই আকর্ষণটা ক্ষীণ হয়ে এসেছে। তবে আমি নিয়মিত আড্ডা দিতে যাই রবীন্দ্র সরোবরে, সেই সঙ্গে সেখানেই চলে প্রাতর্ভ্রমণ। এক দিন না গেলেও কেমন অস্বস্তি বোধ করি। এমনই সেই আড্ডার মাদকতা।

আগের চেয়ে বদলেছে পাড়ার খেলাধুলোর পরিবেশ। আগে রাস্তায় ক্রিকেট খেলা হতো। আর ছোটরা খেলত আইসপাইস, ব্যাডমিন্টন, ফুটবল। সে সব এখন কোথায়? তখন পুজোর পরে বসত গানের জলসা, হতো নাটক। তাতে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অংশগ্রহণ করতেন পাড়ার মানুষ। মনে আছে, এক বার তেমনই এক জলসায় আসর মাতিয়েছিলেন মান্না দে। রাত আটটা থেকে শুরু করে তিনটে পর্যন্ত সুরের মূর্ছনায় মোহিত করে রেখেছিলেন সকলকে। সেই সব জলসা আজ শুধুই স্মৃতি।

পাড়ার দুর্গাপুজোটা অবশ্য এখনও ধুমধাম করে হয়। কালীপুজোও হয়। ওই দিনগুলিতে পাড়ার সকলে ক্ষণিকের জন্য মিলেমিশে যান, গল্পগুজব করেন। কিন্তু ওই পর্যন্তই।

এ পাড়ায় গাড়ির যাতায়াত কিছুটা কম বলেই পার্কিং সমস্যা নেই। কাছাকাছির মধ্যে রয়েছে তিনটি বাজার— চারু মার্কেট, টালিগঞ্জ বাজার আর আনোয়ার শাহ রোড বাজার। পাড়ার চৌহদ্দিতেই রয়েছে তিনটি নার্সিং হোম। তৈরি হয়েছে ভাল একটি ওষুধের দোকানও। সময়ের সঙ্গে নাগরিক পরিষেবা উন্নত হয়েছে, জোরালো আলো বসেছে, নিয়ম করে জঞ্জাল সাফাইও হয়। ফলে রাস্তাঘাটও থাকে পরিষ্কার। তবে বাইরে চেহারার উন্নতি হলেও অন্তরের চেহারাটা মলিন হয়েছে।

এ পাড়া প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়ের। অভিনেত্রী সুলতা চৌধুরীর। মাঝে মাঝে আসতেন অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ও। আমায় বলতেন, ‘‘আমারে মামু বলে ডাকবে।’’

তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা, বেশির ভাগ বাড়িতেই বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা থাকেন। নতুন প্রজন্মের অধিকাংশই কর্মসূত্রে কলকাতার বাইরে কিংবা দেশের বাইরে। এক এক সময় মনে হয়, আমাদের পাড়াটা একটা বৃহৎ বৃদ্ধাশ্রম হয়ে গিয়েছে। সেখানে সন্ধ্যা যত রাতের দিকে গড়ায়, নিঃসঙ্গ অভিভাবকদের পলকহীন সজাগ দৃষ্টি থাকে মোবাইল কিংবা টেলিফোনের দিকে। বহু দূর থেকে আসা একটা ফোনের অপেক্ষায়। নীরব যন্ত্রটা কখনও বেজে ওঠে, কখনও ডুব দেয় অন্তহীন নীরবতায়।

লেখক পরিচিত চিকিৎসক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন