ভাঙনের শেষ কোথায়? আপাতত এটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
গত আট মাসে রাজ্যে ছোট-বড় মিলিয়ে ৩৩টি চিকিৎসক নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে। আর তার চেয়ে অনেক বেশি যা ঘটেছে, তা হল বিশ্বাসের মৃত্যু। ছোটখাটো ঘটনায় বেআব্রু হয়ে গিয়েছে, চিকিৎসক ও রোগী এখন যুযুধান দুই গোষ্ঠী। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। প্রশ্ন হল, এ ভাবে কি আদৌ চলতে পারে? এতে সবচেয়ে ক্ষতি হচ্ছে তো রোগীদের। এই বিশ্বাসভঙ্গের ক্ষেত্রে সরকারের কি কোনও ভূমিকা আছে? যদি থাকে, তা হলে তা কী? কী ভাবেই বা সরকার নিজেদের দায়বদ্ধতার পরিচয় রাখতে পারে?
স্বাস্থ্যকর্তাদের একাংশ মানছেন, আগে বিচ্ছিন্ন ভাবে এমন ঘটে থাকলেও বিষয়টা বড় আকার নেয় টাউন হল-এ বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালের কর্তাদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকের পরে। ওই বৈঠকে রোগী শোষণের অভিযোগ তুলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিছু দিনের মধ্যে তৈরি হয় নতুন আইনও। সরাসরি অভিযোগের নিষ্পত্তির জন্য গঠন করা হয় স্বাস্থ্য কমিশন। স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তার কথায়, ‘‘একাধিক বেসরকারি হাসপাতাল যে ধরনের রোগী শোষণ চালায়, তাতে মুখ্যমন্ত্রীর ওই পদক্ষেপ খুবই জরুরি ছিল। কিন্তু সমস্যা হল, বিষয়টায় কোনও ভারসাম্য থাকেনি। মুড়ি-মিছরি এক হয়ে গিয়েছে। অনেকে ভাবতে শুরু করেন, ডাক্তারদের সঙ্গে যা খুশি করা যায়। এমনকী হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর পরে টাকা না দিয়ে চলে গেলেও আটকানোর কেউ নেই। পান থেকে চুন খসলে ডাক্তারদের গায়ে হাত তুলছেন অনেকে। রাজনৈতিক নেতাদের মদতে পরিস্থিতি ক্রমশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।’’
সরকার কি দায় এড়াতে পারে? আশ্চর্যজনক ভাবে স্বাস্থ্য দফতর এ ক্ষেত্রে নীরব। স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তাঁর জবাব, ‘‘আমি কোনও কথা বলব না। আমি স্বাস্থ্য দফতরের মুখপাত্র নই।’’ কথা বলেননি স্বাস্থ্য সচিব অনিল বর্মাও। আর এখানেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ। তাঁদের বক্তব্য, রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবায় এমন একটা বিপন্ন সময়ে কী ভাবে চুপ করে থাকতে পারেন স্বাস্থ্যকর্তারা?
চিকিৎসক অর্জুন দাশগুপ্ত মেনে নিয়েছেন, চিকিৎসক-রোগী সম্পর্ক ক্রমশ খারাপ হওয়ার পিছনে কিছু ডাক্তারের অসততাও দায়ী। কিন্তু সেটাই একমাত্র ছবি নয়। তিনি বলেন, ‘‘রাজনৈতিক নেতা-গুণ্ডা আর পুলিশ-প্রশাসনের একাংশের আঁতাতে পরিস্থিতি হাতের বাইরে যাচ্ছে। অথচ আমরা শান্ত ভাবে রোগী দেখতে চাই। ঠান্ডা মাথায় অস্ত্রোপচারের ছুরি-কাঁচি ধরতে চাই। সেটা হচ্ছে না।’’
ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর্স ফোরাম-এর তরফে চিকিৎসক রেজাউল করিম মনে করেন, ডাক্তার-রোগী সম্পর্ক এখন ভাঙা কাচের টুকরোর মতো হয়েছে। সহজে জো়ড়া লাগার নয়। একটু অসাবধান হলেই হাত কাটা অনিবার্য। তিনি বলেন, ‘‘যারা হামলা করছেন তাদের গ্রেফতার করে শাস্তির বিষয়টা নিশ্চিত করা জরুরি। তা হচ্ছে না বলেই ডাক্তারদের হতাশা বাড়ছে। অন্য দিকে, ডাক্তারদেরও আত্মসমীক্ষার প্রয়োজন। সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের একটা অংশের যে অনীহা আছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। রোগীদের সঙ্গে আরও বেশি কথা বলা দরকার। এ ক্ষেত্রে প্রশাসনের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখতে হবে, বিচ্ছিন্ন ভাবে দু’-এক জন ডাক্তার নন, সামগ্রিক ভাবে গোটা ‘সিস্টেম’-এর উপরে মানুষ আস্থা হারাচ্ছেন।’’
রোগীদের একাংশের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গিয়েছে, সম্পর্কের এই অবনতি তাঁদেরও অনিশ্চয়তার মুখে দাঁড় করিয়েছে। ক্যানসার রোগী অরিজিৎ মিত্রের কথায়, ‘‘চরম বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে ডাক্তারের হাতটাই খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরতে চান রোগী। সেই খড়কুটোও এখন আর থাকছে না।’’ হৃদ্রোগী অপর্ণা সরকার বলেন, ‘‘যাঁরা কথায় কথায় ডাক্তারদের উপরে হামলা চালান, তাঁরা রোগীর বাড়ির লোক হতে পারেন না। কারণ রোগীর বাড়ির লোকের সেই মানসিক অবস্থায় থাকেন না। এরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাইরের লোক। রাজনৈতিক নেতাদের মদতে এ সব চলে।’’
প্রশ্ন উঠেছে, রাজনৈতিক এই হস্তক্ষেপ কেন সরকার কড়া হাতে দমন করছে না? শাসক দলের নেতা-মন্ত্রীদের মদতে যা ঘটছে, তা সর্বোচ্চ স্তর থেকে কেন নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে না? ডাক্তারদের কাজ বন্ধ করে আন্দোলন সমস্যার কোনও সমাধান হতে পারে না। কিন্তু সে ক্ষেত্রে শুধু হাসপাতালগুলিকে শো কজ করে কি আসল সমস্যা থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা হচ্ছে না? প্রশ্নের জবাব মেলেনি।