রোগীদের সঙ্গে শ্যামল দাস। ছবি: সুদীপ ঘোষ
‘ডিগ্রি’ নেই! অথচ ‘চেম্বার’-এর সামনে রোগীর ভিড়। কেউ এসেছেন মালদহ থেকে, কেউ আবার বনগাঁ। ‘ডাক্তার দাদা’-র দেখা পাওয়া যায় দিনে মাত্র দু’ঘণ্টা। তাই সুযোগ কেউ ছাড়তে রাজি নয়।
বিজ্ঞাপন কিংবা অন্য কোনও প্রচার না থাকলেও ‘ডাক্তার দাদা’-র চেম্বার চিনতে রোগীদের কোনও সমস্যা হয় না। শিয়ালদহ থেকে বনগাঁ লাইনের ট্রেন ধরে হৃদয়পুর স্টেশনে নামলেই স্থানীয় এক চায়ের দোকানেই চেম্বার। কাঠের ছোট্ট ঘর। সামনেই উনুন জ্বলছে। বড় কেটলিতে গরম জল ফুটছে, দোকানি চা বানাচ্ছেন। এখানেই রাত ৮টা থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত নিয়মিত বসেন ‘ডাক্তার দাদা’ শ্যামল দাস। পেশায় তিনি আয়কর অফিসার।
চৌরঙ্গি রোডের আয়কর দফতরের অফিসের কাজ শেষ করে সহকর্মীরা যখন বাড়ির দিকে রওনা দেন, তিনিও রওনা দেন। কিন্তু বাড়ি নয়, ওই চেম্বারের দিকে। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রোগীরা আসেন তাঁর কাছে। কেউ আসেন নিজের সমস্যার জন্য কোন চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত সেই পরামর্শ নিতে। কেউ আবার শারীরিক পরীক্ষা করানোর মতো অর্থ জোগাড় করতে না পেরে, সাহায্য চাইতে। প্রত্যেকের সমস্যার কথা শোনেন শ্যামলবাবু। তাঁর সামর্থ্য মতো সাহায্যও করেন।
আয়কর বিভাগে কাজ করে কী ভাবে চিকিৎসা পরিষেবার বিষয়ে সাহায্য করেন? শ্যামলবাবুর কথায়, ‘‘ভাল কাজ করা আসলে একটা নেশা। যার এই নেশা আছে, নানা সমস্যা থাকা সত্ত্বেও সে কাজটা করে যাবে।’’ প্রতি দিনের অফিসের কাজ শেষ করে, সবাই নিজের মতো সময় কাটান। সেই সময়টাই মানুষের সমস্যা জানতে কাটান শ্যামলবাবু। তাঁর সাহায্যে বিভিন্ন হাসপাতালে যে সব রোগী ভর্তি আছেন, তাঁদের পরিবারের
সঙ্গে অফিসের কাজ সেরে দেখা করতে যান তিনি।
এ কাজের শুরু ২০০৪ সালে। কর্মসূত্রে তখন তিনি চুঁচুড়ায় থাকতেন। এক পরিচিত ব্যক্তি ক্যানসারে ভুগছিলেন। কিন্তু চিকিৎসার সামর্থ্য ছিল না। সেই সময়ে তাঁকে সব রকম সাহায্য করেন শ্যামলবাবু। কিছুটা সুস্থ হয়ে ওঠার পরে অফিসে এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরেছিলেন অসুস্থ ব্যক্তি। সেই আনন্দ, ওই হাসিমুখ, এক জন মানুষের স্বস্তি শ্যামলবাবুকে প্রথম এই কাজে উৎসাহ দেয়।
একাধিক বেসরকারি সংগঠনের সঙ্গে তিনি যুক্ত এখন। মূলত রোগীকে চিকিৎসকের কাছে পৌঁছে দেওয়াই তাঁর কাজ। তবে বহু মানুষ যাঁরা চিকিৎসার খরচ সামলাতে পারেন না, তাঁদের যথাসাধ্য আর্থিক সাহায্য করেন শ্যামলবাবু। কোন হাসপাতালে কোন চিকিৎসা ভাল হয়, কবে কার আউটডোর, কী ভাবে সেখানে পৌঁছাতে হবে, সে ব্যাপারে অনেকেরই ধারণা থাকে না। শুধু সরকারি নয়, বেসরকারি হাসপাতালের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা।
কী ভাবে এত চিকিৎসকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হল? তিনি জানান, আয়কর সংক্রান্ত বিষয় জানতে তাঁর অফিসে নিয়মিত বেশ কিছু চিকিৎসকের যাতায়াত আছে। তাঁদের তিনি আয়কর সংক্রান্ত বিষয়ে সাহায্য করেন। বিনিময়ে অসহায় রোগীদের জন্য চিকিৎসকদের কাছে চেয়ে নেন কিছুটা সময়।
ক্যানসার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘শ্যামলের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় আয়কর দফতরের একটি অনুষ্ঠানে। অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি বিভিন্ন অসহায় মানুষকে হাসপাতালে নিয়ে যান। চিকিৎসক হিসেবে ওঁর
এই কাজে সব সময়ে পাশে থাকতে চাই।’’
হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বিভু চক্রবর্তী বলেন, ‘‘এক বন্ধুর থেকে শ্যামলের ব্যাপারে জানতে পারি। দুঃস্থ রোগীদের তিনি যে ভাবে সাহায্য করেন, সে কথা জেনে আমি চিকিৎসক হিসেবে এগিয়ে আসি ওঁকে সাহায্য করতে। এক জন আয়কর কর্তা হয়েও তিনি মানুষের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য নিয়ে এতটা ভাবেন, এটা দেখে ভাল লাগে।’’