নিরাপত্তা কোথায়, রাত কাটে সঙ্কটেই

দৃশ্য ৩: রাত ১.৩০। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের ইমার্জেন্সি ওয়ার্ড। এখানেও প্রবেশ অবাধ। ঝাঁ চকচকে গেটের কাছে ছোট ঘরে বসে পুলিশকর্মীরা। কিন্তু ইমার্জেন্সি-তে ঢোকার মুখ আগলে নেই কোনও রক্ষী।

Advertisement

মৌ ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৩:২৯
Share:

অরক্ষিতই মেডিক্যাল কলেজের ওয়ার্ড। নিজস্ব চিত্র

দৃশ্য ১: রাত ১২.১০। নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি গেটের কাছে পুলিশ রয়েছে। হঠাৎ রোগী নিয়ে জনা ছয়েক লোক ঢুকে পড়লেন ভিতরেই। পুলিশকর্মী বসেই রইলেন। চারদিকে নিরাপত্তারক্ষীরা আছেন। তাঁরাও ব্যস্ত নিজেদের নিয়েই। কেউ মোবাইলে গেম খেলছেন, কেউ মেতেছেন গল্পগুজবে। উপরে ওয়ার্ডের দিকে উঠে গেলেও বাধা দিতে এগিয়ে এলেন না কেউ। বাধা এল না ওটি-তে ঢোকার মুখেও। এক পাক ঘুরে মেডিসিন ওয়ার্ডে ঢোকার সিঁড়িতে অবশেষে উড়ে এল প্রশ্ন। এক রক্ষী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘‘এখানে কি আপনার কেউ ভর্তি আছেন?’’ কেউ ভর্তি নেই শুনেও অবশ্য নিরুত্তাপ রক্ষী। যেন রাত বারোটার সময়ে বহিরাগতদের ঘোরাঘুরিটাই দস্তুর। পুলিশ নজর রাখে না হাসপাতাল চত্বরে? ঝাঁঝিয়ে উঠে পাল্টা প্রশ্ন রক্ষীর, ‘‘আমরা থাকতে পুলিশ আবার আসবে কেন?’’

Advertisement

দৃশ্য ২: রাত ১২.৫৫। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ইমার্জেন্সিতে তারস্বরে চিৎকার করছেন এক মত্ত যুবক। হঠাৎ এক পুলিশকর্মী এসে ধমকে গেলেন তাঁকে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ফের চিৎকার শুরু করলেন যুবক। গেটের মুখে পুলিশকর্মীরা তখন গল্পে ব্যস্ত। ওই রাতেও অবাধ যাতায়াতে বাধা নেই কারও। ইমার্জেন্সি ওয়ার্ড ঘুরে অনায়াসেই উঠে যাওয়া গেল অর্থোপেডিক ওয়ার্ডে। পুলিশ তো নেই-ই, দেখা মিলল না রক্ষীরও।

দৃশ্য ৩: রাত ১.৩০। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের ইমার্জেন্সি ওয়ার্ড। এখানেও প্রবেশ অবাধ। ঝাঁ চকচকে গেটের কাছে ছোট ঘরে বসে পুলিশকর্মীরা। কিন্তু ইমার্জেন্সি-তে ঢোকার মুখ আগলে নেই কোনও রক্ষী। ফলে অনায়াসেই ঢুকে যাওয়া যায় সেখানেও। দূরে বাইকের উপরে বসা রক্ষীও ব্যস্ত মোবাইলে। বার কয়েক তাঁর সামনে দিয়ে যাতায়াত করলেও নজরে পড়ে না তাঁর।

Advertisement

অর্থাৎ, রাতের হাসপাতালে পুলিশ থাকলেও নেই নিরাপত্তা। ফলে রাতের হাসপাতালে মত্ত যুবকদের উপদ্রব ও দালালরাজ চলছে নির্বিঘ্নেই। সম্প্রতি শহরের কয়েকটি হাসপাতাল ঘুরে চোখে পড়ল এমনই দৃশ্য।

অবস্থা এমনই যে নিরাপত্তা নিয়ে সঙ্কটে জুনিয়র চিকিৎসকেরা। তাঁদের একাংশের অভিযোগ, রাতে রোগীর অবস্থা সামান্য খারাপ হলেই মুশকিল। রোগীর বাড়ির লোকজনেরা চড়াও হলেও এগিয়ে আসেন না কোনও রক্ষী। ফোন করে পুলিশকে ডাকতে ডাকতে অনেক ক্ষেত্রেই ব়ড় আকার নেয় সমস্যা। এক মহিলা চিকিৎসক জানালেন, দিন কয়েক আগেই রাতের ডিউটিতে বিপদে পড়েছিলেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘হঠাৎ একদল লোক হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লেন ইমার্জেন্সিতে। রোগী দেখব কী ভাবে, বাড়ির লোকেরা প্রায় উঠে আসছিলেন ঘাড়ের উপরে। চিকিৎসাটাও ভাল ভাবে করতে পারছিলাম না। যত পিছিয়ে আসছিলাম, তাঁরা ততই এগোচ্ছিলেন আমার দিকে। দরজার বাইরে কোনও রক্ষীকেও দেখতে পেলাম না, যে একটু সাহায্য চাইব।’’

এমনই অভিজ্ঞতা আছে আর এক পুরুষ চিকিৎসকেরও। তিনি জানান, রক্ষী না থাকায় কয়েক দিন আগেই রোগী ছেড়ে রোগীর পরিজনেদের সামলানোর কাজে নামতে হয়েছিল তাঁর তিন সহকর্মীকে। তিনি বলেন, ‘‘এত জনে মিলে ঢুকে এসে হঠাৎ হইচই শুরু করেছিলেন যে, মাথা ঠান্ডা রেখে চিকিৎসা করাই মুশকিল হচ্ছিল। তাঁদের থামতে বললে উল্টে চেঁচামেচি আরও বাড়ল। চিকিৎসা করব না বাড়ির লোককে সামলাব? শেষে পুলিশ ডাকতে বাধ্য হলাম।’’

এমন পরিস্থিতি সামলাবে কে? মত কী প্রশাসনের? সব শুনে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকর্তা দেবাশিস ভট্টাচার্য বক্তব্য, ‘‘আপনাদেরও তো উচিত হাসপাতালে অনুমতি নিয়ে ঢোকা। কিন্তু আপনারাও তা করেন না। এটাও ঠিক নয়।’’ কিন্তু কে ঢুকছে, তা কি দেখার দায়িত্ব নয় হাসপাতালের রক্ষীদেরও? দেবাশিসবাবুর উত্তর, ‘‘সাধারণ ভাবে সেটা দেখা হয়। তবে এ ক্ষেত্রে কী হয়েছিল, তা না জেনে বলা সম্ভব নয়।’’ কলকাতা পুলিশের এক কর্তা বলেন, ‘‘হাসপাতালে পুলিশ ফাঁড়ি রয়েছে। নিয়মিত টহল দেওয়া হয়। তার পরেও এমন ঘটার কথা নয়। ডাক্তার বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফে অভিযোগ এলে আমরা অবশ্যই খতিয়ে দেখব।’’

জুনিয়র ডাক্তারদের একটা বড় অংশই অবশ্য প্রশ্ন তুলেছেন, ‘খতিয়ে’ দেখতে দেখতে ফের পরের হামলার ঘটনা ঘটে যাবে না তো?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন