দক্ষিণ ভারতের তুলনায় এখনও অনেক পিছিয়ে। তবে সরকারের দাবি, লড়াইয়ের প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ। কিন্তু পরিকাঠামো এবং সচেতনতার অভাব যে এ রাজ্যেকে অঙ্গ প্রতিস্থাপনে এখনও অনেকটাই কমজোরি করে রেখেছে তা মেনে নিচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্তাদের একটা বড় অংশই। তাঁদের বক্তব্য, কোথাও সঠিক সময়ে মৃতদেহের অঙ্গ সংগ্রহ করা হচ্ছে না। কোথাও প্রতিস্থাপনের অস্ত্রোপচারের পরে সংক্রমণ ঘটছে। আবার কোথাও সচেতনতার অভাবে বহু মানুষ অঙ্গদানের প্রয়োজনীয়তার কথা জানতেই পারছেন না। এই তিনটি দিককে এক সঙ্গে মেলাতে না পারলে অঙ্গ প্রতিস্থাপনে সাফল্য সম্ভব নয়।
অঙ্গ প্রতিস্থাপনে বিগত ক’বছরে সামান্য এগিয়েছে কলকাতা। স্বাস্থ্য দফতর পুলিশের সাহায্যে কোথাও গ্রিন করিডর তৈরি করে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা করেছে। আবার কোথাও ব্যাঙ্ক তৈরি করে অঙ্গ সংরক্ষণের পরিকাঠামো তৈরি করে তা ব্যবহারের চেষ্টা চালাচ্ছে। সম্প্রতি একটি বেসরকারি সংস্থা কলকাতায় অঙ্গ প্রতিস্থাপন নিয়ে একটি সমীক্ষা চালিয়েছে। ওই সমীক্ষা অনুসারে, শেষ তিন বছর এ শহরে প্রায় ২০ শতাংশ অঙ্গ প্রতিস্থাপনের হার বেড়েছে। যদিও এই বৃদ্ধি পর্যাপ্ত নয় বলেই মনে করছেন অঙ্গ প্রতিস্থাপনের সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসকেরা। তাঁদের মতে, বিপুল চাহিদার তুলনায় এই জোগান নেহাৎই সামান্য।
বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, কিডনি, লিভার, চোখ, ত্বক প্রতিস্থাপন এ রাজ্যে হলেও হৃদপিণ্ড এবং ফুসফুস প্রতিস্থাপনের জন্য এখনও ভিন্ রাজ্যের উপরে নির্ভর করতে হচ্ছে। তবে, পরিকাঠামোর পাশাপাশি সচেতনতার অভাব অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে উঠেছে। অঙ্গ না পাওয়ার জেরে ভারতে প্রতি বছর পাঁচ লক্ষ অঙ্গ প্রতিস্থাপনের আবেদনকারী মারা যান। তাঁর মধ্যে একটা বড় অংশ এ রাজ্যের বাসিন্দা। সচেতনতা বাড়লে বহু মানুষ সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন।
চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, বার্ধক্যজনিত সমস্যায় কিংবা কোনও সংক্রামক রোগে ‘ব্রেন ডেথ’-এর পরে অনেক সময়ে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের সুযোগ থাকে না। কারণ, দীর্ঘ দিন নানা ওষুধ ব্যবহারের জেরে অনেক ক্ষেত্রে অঙ্গ প্রতিস্থাপনে সমস্যা তৈরি হয়। কিন্তু পথ দুর্ঘটনায় ‘ব্রেন ডেথ’-এর ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই ধরণের সমস্যা হয় না। তাই পথ দুর্ঘটনায় ‘ব্রেন ডেথ’ হলে পরিবার যাতে অঙ্গদানে সম্মত হয়, সে বিষয়ে অধিক গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা জরুরি। আর এখনও পর্যন্ত ঘাটতিটা সেখানেই রয়ে গিয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হারে ভারত বিশ্বে প্রথম সারিতে রয়েছে। বছরে পথ দুর্ঘটনায় মোট মৃত্যুর ১০ শতাংশই এ দেশে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিবারের কোনও সদস্যের পথ দুর্ঘটনায় ‘ব্রেন ডেথ’ হলে অন্যদের যে মানসিক পরিস্থিতি থাকে, তখন তাঁদের অঙ্গদানের গুরুত্ব সম্পর্কে বোঝানো সম্ভব নয়। তাই সরকারকে অঙ্গদানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বিশদে প্রচার করতে হবে। যাতে যে কোনও পরিস্থিতিতে অঙ্গদানের প্রয়োজনীয়তা সাধারণ মানুষ উপলব্ধি করতে পারেন।
নেফ্রোলজিস্ট দীপকশঙ্কর রায় বলেন, ‘‘এ রাজ্যের মানুষ আগে প্রতিস্থাপনের জন্য ভিন্ রাজ্যে যেতেন। কিন্তু এখন অনেক বেশি মানুষ কলকাতাকে ভরসা করছেন। কিন্তু আবেদনকারীর তুলনায় এখনও দাতার অনুপাত কম।’’ গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্ট অভিজিৎ চৌধুরী বলেন, ‘‘শুধুই চিকিৎসক নয়, সমাজের সব স্তর থেকে অঙ্গদানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতার প্রসার জরুরি। দক্ষিণ ভারত এগিয়ে কারণ, সেখানে পুলিশকর্তা থেকে ভুক্তভোগী সবাই এ কাজে এগিয়ে এসেছেন। অঙ্গ না পাওয়ার জেরে যাঁরা ভুক্তভোগী তাঁদের কথা বেশি তুলে ধরতে হবে। পাশাপাশি স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ট্রমা কেয়ারকে আরও উন্নত করতে হবে। দুর্ঘটনায় নিজের পরিবারের সদস্য ভাল স্বাস্থ্য পরিষেবা না পেলে সমাজকে সাহায্যের ইচ্ছে তৈরি হয় না।’’
স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা দাবি করছেন, সঠিক সময়ে অঙ্গ সংগ্রহ এবং প্রতিস্থাপনের পরে সংক্রমণের হার কমানোর জন্য নানা পদক্ষেপ করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে সামান্য গাফিলতি প্রমাণিত হলে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলিকে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। সরকারি হাসপাতালগুলির পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতালগুলি অঙ্গ প্রতিস্থাপন পরিকাঠামো গড়ে তুলতে আগ্রহী। স্বাস্থ্যভবনের কর্তাদের একাংশের আশা, দ্রুত এ শহরে হৃদপিণ্ড ও ফুসফুস প্রতিস্থাপন কেন্দ্র তৈরি হবে। দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ইতিমধ্যে শহরের একাধিক বেসরকারি হাসপাতাল কিডনি, লিভারের পাশাপাশি হৃদপিণ্ড এবং ফুসফুস প্রতিস্থাপনের অনুমতি চেয়ে স্বাস্থ্য দফতরে আবেদন জানিয়েছে। দফতরের এক শীর্ষকর্তার কথায়, ‘‘আবেদনকারী হাসপাতালগুলোর পরিকাঠামো পরিদর্শনের পর্ব চলছে। সব কিছু ঠিক থাকলে কিছু দিনের মধ্যেই এ রাজ্য অঙ্গ প্রতিস্থাপনে আরও এগিয়ে যাবে।’’
সচেতনতা প্রসারের প্রয়োজনীয়তা মেনে নিচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্তারাও। অতিরিক্ত স্বাস্থ্য অধিকর্তা অদিতিকিশোর সরকার বলেন, ‘‘বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন করে সব বয়সীদের মধ্যে সচেতনতা চালানো হচ্ছে। আশা রাখছি, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে অঙ্গ প্রতিস্থাপনে এ রাজ্য সামনের সারিতে আসবে।’’