বারাসত

শৌচাগারে যেতে চাইলে বাড়ি পাঠায় স্কুল

প্রত্যন্ত গ্রাম নয়। খোদ বারাসত শহরের বুকে ১৭০০ ছাত্রছাত্রী, ৫১ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা-পার্শ্বশিক্ষক-শিক্ষাকর্মী নিয়ে এ ভাবেই চলছে ষাট বছরের পুরনো, সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত অশ্বিনীপল্লি হাইস্কুল। শৌচাগারের প্রয়োজন পড়লে কোথায় যাবে, সেই প্রশ্নে স্কুল চলাকালীন প্রতিদিনই বাধ্য হয়ে কিছু ছাত্রীকে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে হয়। স্কুলে যাওয়ার নামে থমকে যায় বহু পড়ুয়া। দরকারে পাড়ার কারও বাড়িতে ছুটতে হয় শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২১ মার্চ ২০১৬ ০১:১৪
Share:

শৌচাগারে যাওয়ার পথ। সুদীপ ঘোষের তোলা ছবি।

ছাত্র আছে। ছাত্রী আছে। শিক্ষক-শিক্ষিকা-শিক্ষাকর্মীরাও। নেই শুধু ব্যবহারযোগ্য শৌচাগার।

Advertisement

প্রত্যন্ত গ্রাম নয়। খোদ বারাসত শহরের বুকে ১৭০০ ছাত্রছাত্রী, ৫১ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা-পার্শ্বশিক্ষক-শিক্ষাকর্মী নিয়ে এ ভাবেই চলছে ষাট বছরের পুরনো, সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত অশ্বিনীপল্লি হাইস্কুল। শৌচাগারের প্রয়োজন পড়লে কোথায় যাবে, সেই প্রশ্নে স্কুল চলাকালীন প্রতিদিনই বাধ্য হয়ে কিছু ছাত্রীকে বাড়ি পাঠিয়ে দিতে হয়। স্কুলে যাওয়ার নামে থমকে যায় বহু পড়ুয়া। দরকারে পাড়ার কারও বাড়িতে ছুটতে হয় শিক্ষক-শিক্ষিকাদেরও।

মরিয়া হয়ে দিদিমণি, মাস্টারমশাই আর ছাত্রছাত্রীদের একাংশ বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। লিখিত অভিযোগ জানিয়ে এসেছিলেন জেলাশাসক মনমীত নন্দার কাছে। গিয়েছিলেন বিকাশ ভবনেও। প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘‘আর্থিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীদের স্কুল হওয়ার জন্যই কি এই হেনস্থা? ওই স্কুলে পড়ার এবং পড়ানোর সুস্থ পরিবেশ কি পাওয়া যাবে না?’’ জেলাশাসকের নির্দেশে তদন্ত হয়েছিল। সমস্ত অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় দোষীদের শাস্তির সুপারিশও হয়। কিন্তু তার পরেও কেটে গিয়েছে ছ’মাস। ছবিটা অবশ্য পাল্টায়নি।

Advertisement

অশ্বিনীপল্লি হাইস্কুলের শৌচাগারের চেহারাটা এখন ঠিক কেমন? দুরবস্থার শুরুটা শৌচাগারে যাওয়ার পথ থেকেই। আবর্জনার স্তূপ জমে পাহাড়প্রমাণ। তা পেরিয়ে দু’টি ঘর। ভেঙেচুরে গিয়েছে। জলও নেই। ফলে তালাবন্ধই পড়ে রয়েছে স্কুলের দুই শৌচাগার।

স্কুলের উঠোনে দাঁড়িয়েই নবম শ্রেণির ছাত্রী জানায়, শৌচাগারের অভাবে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি এড়াতে মাসের অধিকাংশ দিন সে স্কুলেই আসে না। তার কথায়, ‘‘শৌচাগরগুলো ব্যবহার করার মতো অবস্থাই নেই। অতক্ষণ স্কুলে থাকতে হয়। দরকার পড়লে যাব কোথায়?’’ পাশ থেকে সহপাঠীরা জানায়, প্রাইমারির পড়ুয়াদের অনেকে ক্লাসরুম বা জামাকাপড় নোংরা করে ফেলে। আর শিক্ষক-শিক্ষিকা-শিক্ষাকর্মীরা বেরিয়ে পড়েন স্কুল ছেড়ে। পাড়ার কেউ যদি দয়াপরবশ হয়ে শৌচাগার ব্যবহারের সুযোগ দেন!

পরিকাঠামোর শোচনীয় হালের অবশ্য এখানেই শেষ নয়। বিজ্ঞান, নিউট্রিশন, ভূগোল বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের ল্যাবরেটরি রুমের নামে রয়েছে ধুলো পড়া খালি ঘর। তাতে কোনও যন্ত্রপাতি নেই। ফলে কোনও প্র্যাকটিক্যাল হয় না, রেজাল্টও হয় শোচনীয়। অথচ ল্যাবরেটরির জিনিস কেনার জন্যও সরকারি অনুদান এসেছে। অভিযোগ, স্কুলের এই অবস্থার জেরে মাত্র কয়েক বছরে ২৫০০ থেকে কমে পড়ুয়ার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৭০০-য়। স্কুলের এক প্রবীণ শিক্ষিকার কথায়, ‘‘আমাদের কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকা, ছাত্রছাত্রী তবু সাহস করে প্রশাসনিক স্তরে অভিযোগ দায়ের করতে পেরেছে। রাজ্যের অন্যত্র, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে না জানি এমন কত স্কুল রয়েছে! হয়তো কেউ সাহস করে অভিযোগটুকু করতে পারছেন না। তাদের অবস্থা প্রশাসন পর্যন্ত পৌঁছচ্ছে না।’’

২০১৫ সালে অভিযোগ পেয়ে উত্তর ২৪ পরগনার জেলাশাসক মনমীত নন্দার নির্দেশে ওই স্কুলে তদন্ত চালান জেলার অতিরিক্ত জেলাশাসক এবং সর্বশিক্ষা মিশনের একাধিক কর্তা। জেলাশাসকের তরফে সর্বশিক্ষা মিশনের স্টেট প্রোজেক্ট ডিরেক্টরকে লেখা রিপোর্টের ছত্রে ছত্রে স্কুলে দুর্নীতির অভিযোগ ও বেহাল পরিকাঠামোর সত্যতা স্বীকার করা হয়েছে। লেখা হয়েছে—২০০৪ থেকে শুরু করে ২০১০ পর্যন্ত শৌচাগার তৈরি ও পানীয় জলের ব্যবস্থার জন্য বারবার সরকারি অনুদান আসা সত্ত্বেও এই শোচনীয় হাল। ২০১৪-১৫ সালে সর্বশিক্ষা অভিযানের তরফে স্কুলের পরিকাঠামো উন্নয়নে ১৪ লক্ষ ৫৬ হাজার টাকার অনুদান দেওয়া হয়। তা খরচও করা হয়নি আবার ফেরতও দেওয়া হয়নি।

গত কয়েক বছরে স্কুলের টাকা খরচের কোনও হিসেব তদন্তকারীদের দেখাতে পারেননি প্রধানশিক্ষক শ্যামসুন্দর পাল। গত ফেব্রুয়ারিতেই সর্বশিক্ষা মিশনের জেলা প্রকল্প অফিসার চিঠি লিখে বারাসত সার্কেলের প্রোজেক্ট কো-অর্ডিনেটরকে ওই প্রধানশিক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে বলেন। সেই নির্দেশ এখনও কার্যকর হয়নি। প্রধানশিক্ষক আপাতত ১০ দিনের ছুটিতে। সারাদিন তাঁর ফোন বন্ধ। বারাসতের কালিকাপুরে তাঁর বাড়িতে গেলেও তিনি কথা বলতে চাননি।

রাজ্যে কত শতাংশ সরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলে শৌচাগার রয়েছে? শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের উত্তর, ‘‘১০০ শতাংশ স্কুলে।’’

সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলগুলি এক বার তৈরি হওয়ার পরে তার পরিকাঠামো ঠিক রয়েছে কি না, বা সরকারি অনুদান সঠিক ভাবে ব্যবহার হচ্ছে কি না— তাতে নজরদারির দায়িত্ব কার? শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘‘আলাদা মনিটরিং সেল রয়েছে। কিন্তু তারা তো লাঠি নিয়ে রাজ্যের সব স্কুলের খুঁটিনাটি দেখতে পারে না। সেটা জেলাশাসকদের দেখতে হবে। গলদ কিছু দেখলে ব্যবস্থাও নেবেন তাঁরাই। সেই ক্ষমতা তাঁদের দেওয়া রয়েছে।’’

তা হলে অশ্বিনীপল্লি স্কুলে এই অবস্থা কেন? পার্থবাবুর জবাব, ‘‘শৌচাগার তো ওই স্কুলে রয়েছে। কিন্তু তা ব্যবহারযোগ্য করে রাখা স্কুল কর্তৃপক্ষের কর্তব্য। তিনি কর্তব্য পালন না করলে জেলাশাসক ব্যবস্থা নেবেন। তিনি কেন শুধু রিপোর্ট দিয়ে দায়িত্ব সারছেন? কেন নিজের থেকে ব্যবস্থা নেননি? কেউ তো শিক্ষা সচিব বা আমাকে তো এ ব্যাপারে কিছু জানাননি। তা হলে আমরা জানব কী করে?’’ জেলাশাসক মনমীত নন্দা এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করতে চাননি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন