বেহালার নূতন দলের এ বছরের প্রতিমা।—নিজস্ব চিত্র।
অনেকটাই উলটপুরাণ! গলি থেকে রাজপথ বা ফুটপাথের দখল নিয়ে, গেরস্তকে বাড়ির জানলা পর্যন্ত খুলতে না দিয়ে পুজোর মণ্ডপ বাঁধা যে শহরে যুগ যুগ ধরে সংস্কৃতি, সেখানে সচরাচর এমনটা ঘটে না।
শহরের জনপরিসরে কারও অসুবিধা না করে ‘ইনস্টলেশন আর্ট’ (স্থাপনা শিল্প) কী ভাবে সৌন্দর্যায়ন করতে পারে, কলকাতার পুজোর মণ্ডপ থেকেই এ বার প্রেরণা পাচ্ছে লন্ডন ও বেঙ্গালুরু। এ বছরের পুজোয় বেহালার নূতন দল যে নির্মাণশৈলী মেনে মণ্ডপ গড়েছিল, সেই আদলে বেঙ্গালুরুর কাবন পার্কে মণ্ডপ সাজানোর কথা পাকা এ মাসের শেষেই। আর লন্ডনের টেমস উৎসবের অধিকর্তা এড্রিয়ান ইভান্সও পুজোর ঠিক পরেই নূতন দলের মণ্ডপটি ঘুরে দেখেছেন। পরের বছর টেমসের ধারে একই ধরনের স্থাপনা শিল্পের কাজের জন্য বেহালার ওই মণ্ডপের রূপকারের সঙ্গে কথা হয়েছে উৎসব কর্তৃপক্ষের। টেমস উৎসবে গত বার কলকাতার দুর্গাপুজো নিয়ে একটি প্রদর্শনী ঠাঁই পেয়েছিল। এ বার কলকাতার ওই পুজোমণ্ডপটির অনুকৃতি নির্মাণ নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা। নিউ টাউনে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা কলকাতা গেটকে ঘিরে শিল্প স্থাপনার অঙ্গ হিসেবেও ওই মণ্ডপটির শৈলী ব্যবহার করা হবে বলে হিডকো-র সভাপতি দেবাশিস সেন জানিয়েছেন।
কলকাতার মণ্ডপ বা থিম, দু’-তিন বছর বাদে জামশেদপুর বা আসানসোলের পুজো ব্যবহার করছে, এমন নমুনা বেশ কিছু মিলবে। কিন্তু কলকাতার মণ্ডপশৈলীকে দেশ-বিদেশের আধুনিক, শহুরে স্থাপনা শিল্পের আদর্শ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে, তা কিছুটা ব্যতিক্রমী ঘটনা। স্থপতি অবিন চৌধুরী এ বারই প্রথম দুর্গাপুজোর মণ্ডপের সঙ্গে জড়িয়েছেন। শহরের জনজীবন কোনও ভাবে ব্যাহত না করে মাঠ বা রাস্তায় ক্ষণস্থায়ী স্থাপনা শিল্প কী ভাবে গড়ে তোলা যায়, তার শিক্ষার একটা ক্ষেত্র হিসেবেও মণ্ডপটিকে দেখা হচ্ছে। আদতে হুগলির বাঁশবেড়িয়ার বাসিন্দা অবিন ২০১২ সালে কার্তিক পুজোয় বাঁশবেড়িয়াতেই একটি অভিনব মণ্ডপ গড়েছিলেন। পরে নিউ ইয়র্কের মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টে একটি প্রদর্শনীতে কম খরচের শিল্পকাজের নমুনা হিসেবে তা ঠাঁই পায়। এ বার দুর্গাপুজোর মণ্ডপশৈলী নিয়েও নানা মহলে আলোচনা চলছে।
বেঙ্গালুরুতে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে বসছে ইন্টারন্যাশনাল ডিজাইন ফেস্টিভ্যালের আসর। সেখানে যাচ্ছে কলকাতার মণ্ডপ। উৎসবের আয়োজক সুপ্রীতা মূর্তির কথায়, ‘‘বাচ্চাদের খেলার ধাঁচে পরপর ব্লক সাজিয়ে মণ্ডপটা তৈরি হয়েছে। এমন মণ্ডপ গড়া ও ভাঙা, দু’টোই সুবিধাজনক।’’ অবিন তাঁর কাজকে বলছেন, ‘স্টিল সিম্ফনি’। বেহালার পুজোর মাঠে চার মাপের ৮৩৫টি জালে ঘেরা লোহার ব্লক সাজানো হয়েছে। হিডকো-কর্তা দেবাশিসবাবুরও ইচ্ছে, ওই ব্লকগুলিকে নিউ টাউনে কলকাতা গেটের পাশের পার্কে ব্যবহার করার। দেবাশিসবাবুর মত, ‘‘একেলে শহুরে স্থাপত্য ও সৌন্দর্যায়নে মূর্তি বা প্রথাগত ভাস্কর্যের বদলে বিমূর্ত স্থাপত্য তৈরি করাই এখন দস্তুর।’’
নিউ টাউনের অ্যাকশন এরিয়া-৩ এবং একটি শপিং মল সংলগ্ন ট্র্যাফিক আইল্যান্ড বা নবদিগন্তের কাছে এই ধরনের স্থাপত্যের নমুনা রয়েছে। স্থায়ী বেদী বা নির্মাণের বদলে সুবিধা মতো সরানো বা পাল্টে ফেলা যাবে, এমন স্থাপনার প্রতিও ঝোঁক বাড়ছে বলে অভিমত স্থপতিদের। রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের সদস্য তথা স্থপতি পার্থরঞ্জন দাসেরও মত, ‘‘পুরনো কাজের অনুকরণের বদলে বিমূর্ত স্থাপনা শিল্প অনেক ক্ষেত্রেই মৌলিকতার দাবি রাখে।’’