কাঁপল মহানগর

কম্পিত কলকাতা, পথে নেমে এল শঙ্কিত শহর

সপ্তাহান্তের ছুটির মেজাজ বা পুরভোটের উত্তেজনা— চিড় ধরল দু’টোতেই। তার বদলে হঠাৎ কাঁপুনিতে যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুভয়ের স্পর্শ! শনিবার বারবেলায় কলকাতায় শিরদাঁড়ায় একটা হিমস্রোত বয়ে গেল। এমনিতে ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল থেকে ঢের দূরে বড় জোর ডানার ঝাপটাটুকু টের পেয়েছে কলকাতা। তাতেই মুহূর্তের জন্য জনজীবন প্রায় ছত্রভঙ্গ। নবান্নের চোদ্দোতলায় খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘরের অ্যাকোয়ারিয়ামের মৎস্যকুল থেকে মেট্রোর যাত্রী— দিশাহারা সকলেই।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৫ ০১:০৭
Share:

এ কোন সকাল! বহুতলের ফ্ল্যাট থেকে প্রাণভয়ে সন্তান কোলে রাস্তায়। শনিবার এন্টালিতে। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

সপ্তাহান্তের ছুটির মেজাজ বা পুরভোটের উত্তেজনা— চিড় ধরল দু’টোতেই। তার বদলে হঠাৎ কাঁপুনিতে যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুভয়ের স্পর্শ! শনিবার বারবেলায় কলকাতায় শিরদাঁড়ায় একটা হিমস্রোত বয়ে গেল।

Advertisement

এমনিতে ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল থেকে ঢের দূরে বড় জোর ডানার ঝাপটাটুকু টের পেয়েছে কলকাতা। তাতেই মুহূর্তের জন্য জনজীবন প্রায় ছত্রভঙ্গ। নবান্নের চোদ্দোতলায় খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘরের অ্যাকোয়ারিয়ামের মৎস্যকুল থেকে মেট্রোর যাত্রী— দিশাহারা সকলেই। বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে ভূমিকম্পের আধ ঘণ্টা বাদেও পরবর্তী কম্পনের ধাক্কা। সঙ্গে রটনা, বিকেল তিনটের পরে নাকি আরও তীব্র ভূমিকম্প হবে। বৃষ্টিবাদলের দিনে এই ‘গুজব-ত্রাস’ও কলকাতাকে নাজেহাল করে ছাড়ল। শহরে মোবাইল-সংযোগের হালও কিছুক্ষণের জন্য বেসামাল হয়ে পড়ে। টেলিকম সংস্থাগুলির দাবি, এ-ও কম্পন-আতঙ্কের বহিঃপ্রকাশ। এক সঙ্গে বহু মানুষ ফোন করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ায়, লাইন জ্যাম হয়ে এমন দশা হয়েছে। বড়সড় ক্ষয়ক্ষতি না হলেও হতভম্ব শহরের ছবিটা কবেকার রবীন্দ্র-কবিতার স্বপ্নদৃশ্যটিই ফিরিয়ে এনেছিল। কলকাতা যেন সত্যিই চলতে শুরু করেছিল ‘নড়িতে-নড়িতে’! পুরনো বাড়ির কার্নিশে ঠোকাঠুকি, বহুতলের দেওয়ালে গভীর ফাটল, লিফ্‌টে আচমকা কাঁপুনি, হোটেলের ঝাড়লণ্ঠন চুরমার কিংবা সেকেলে স্কুলবাড়ির ক্লাসঘরে চেয়ার-টেবিলের ঠকঠক ইত্যাদি...! ফলে, আতঙ্কে প্রাণ নিয়ে পথে নামে মানুষ। প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডে এক মাল্টিপ্লেক্সে ১১টা ২৫ মিনিটের শো শুরু হতে না-হতেই থমকে যায়। লাউডস্পিকারে ঘোষণা শুনে পপকর্নের প্যাকেটের মায়া ত্যাগ করেই হুড়মুড়িয়ে ছুটলেন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি অফিসার। দুলুনিতে টাল সামলে পড়িমরি করে এসক্যালেটর ধরে ঝাঁকে-ঝাঁকে নামছে জনতা। ভূমিকম্পের ঘণ্টা চারেক পরে যাদবপুরের প্রবীণ গৃহিনী সুতপা ঘোষ বিকেলেও বলছিলেন, ‘‘খালি মনে হচ্ছিল, শপিং মলের কাচগুলো যেন এই ঝনঝনিয়ে ভেঙে পড়বে। এখনও মাথা ঘুরছে, বমি পাচ্ছে!’’

পুরসভা ও পুলিশ সূত্রে খবর, ইলিয়ট রোড, সাপগাছি ফার্স্টলেন, চৌবাগা রোড, নর্দার্ন অ্যাভিনিউ-এ বাড়ি হেলে পড়েছে। মুরারিপুকুর রোডে বিআরএস ভবনের ৬ নম্বর ব্লকের চারতলার সিঁড়ির আংশিক ক্ষতি হয়। বড়তলা স্ট্রিট, রাজা রামমোহন স্ট্রিট, কলাকার স্ট্রিট, কয়লাঘাট স্ট্রিট থেকে দেওয়ালে ফাটলের খবর আসে।

Advertisement

চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, পার্ক স্ট্রিট, ক্যামাক স্ট্রিট থেকে শিয়ালদহ, সল্টলেক— ছবিটা সর্বত্র এক। গলি থেকে রাজপথে প্রাণপণে ছুটছে জনতা। সল্টলেকের বিদ্যুৎ ভবন মুহূর্তে ফাঁকা। বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউ-তে পর্যন্ত রোগীকে রেখে নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীরা ছুটে পালিয়েছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। শিয়ালদহের একটি আবাসনে কিন্তু দেখা গেল, এক প্রবীণ মহিলাকে চেয়ারে বসিয়ে যত্ন করে নামালেন দুই যুবক। দক্ষিণ কলকাতার হোটেলের ব্যাঙ্কোয়েট হলে হঠাৎ আছড়ে পড়ে ভেঙে যায় ঝাড়লণ্ঠন। ভেস্তে যায় বণিক সংগঠনের সভা। মেট্রো পরিষেবাও ঘণ্টাখানেকের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। স্টেশনে মাইকে ‘ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প’ হচ্ছে বলে ঘোষণাতেও যাত্রীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে বলে অভিযোগ। তারাতলা উড়ালপুলের দক্ষিণ দিকের ১০০ মিটার পথে সরু চিড় দেখা গিয়েছে। পার্ক স্ট্রিট উড়ালপুলের রাস্তায় ক্ষতচিহ্নও ভূমিকম্পের চিহ্ন বলেই রটে গিয়েছিল। পুলিশের অবশ্য দাবি, সে-ফাটল টাটকা নয়, পুরনো।

নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে অ্যাকোয়ারিয়মের কাচ ভেঙে জলসুদ্ধ মাছেরা অবশ্য দুপুরেই মেঝেয় গিয়ে পড়েছে। কালীঘাটের বাড়িতে পরিবারের অন্যদের নিয়ে বাইরে ফাঁকায় বেরিয়ে এসেছিলেন মমতা। ফোনে নবান্নে শীর্ষ স্তরের আমলাদের খোঁজখবর নিয়ে কোনও ঝুঁকি না-নিতে বলে তাঁর কড়া নির্দেশ, ‘‘কেউ দোতলার উপরে থাকবেন না!’’

রাজ্য জুড়ে পুরভোটে ঘটনার ঘনঘটার আবহে নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় তাঁর চেয়ার ছেড়ে উঠতে পারেননি। তবে কম্পন-আতঙ্কে তাঁর অফিস প্রায় ফাঁকা হয়ে যায়। পড়িমরি করে নামার কিছুক্ষণ বাদে এক কর্মী জিভ কাটলেন, ‘‘ইস্‌, দোতলার অফিস ঘরে স্যার বোধহয় একা রয়েছেন।’’ পরে সুশান্তবাবু বলেন, ‘‘বুঝতে পারছিলাম, চেয়ার দুলছে। কিন্তু কাজের মধ্যে ছিলাম বলেই উঠব উঠব করেও আর বেরোনো হল না!’’ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে মুখ্যমন্ত্রী নিজেও পরে নবান্নে যান। ভূমিকম্পের সৌজন্যে তৃণমূল ভবনে শাসক দলের কন্ট্রোল রুমে পর্যন্ত দেখা গেল, ভুল বোঝাবুঝি। হঠাৎ দুলুনিতে বিস্মিত পার্থ চট্টোপাধ্যায় পাশে বসা সুব্রত বক্সীকে বলে ফেলেন, ‘‘কী রে আমায় ঠেলা মারছিস কেন!’’

গাড়িতে চলতে চলতে ‘ভূমিকম্প’ বলে প্রথমটা বুঝতে পারেননি ট্যাক্সিচালক মহম্মদ নবাবও। বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে চারপাশের বাড়ি অফিস থেকে দলে-দলে লোকে নামছে দেখে ঘাবড়ে গিয়ে পর পর ফোন, আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের বাড়িতে, পটনায় শ্বশুরবাড়িতে। সন্তোষপুরের মহাশ্বেতা ভট্টাচার্য ভূমিকম্প চলাকালীন কাশীতে কর্মরত পুত্রের ফোন পেয়েছেন। মাকে ছেলের কড়া নির্দেশ, তালা-চাবি হাতে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোও! ছেলের ওখানেও জোরালো ভূমিকম্প হয়েছে। ‘‘হ্যাঁ রে, তুই ঠিক আছিস, এই তো আমি বাড়ি থেকে বেরোচ্ছি’ বলে নামতে নামতেই টের পেলেন কাছে রাসমণি বাগানের পুকুরের জল সুনামির মতো উপচে পড়ছে। দমদমের ক্ষুদিরাম কলোনিও সবিস্ময়ে দেখেছে, পাড়ার সাঁতারপুলের জল কী ভাবে উথলানো দুধের মতো ফুটপাথ ভিজিয়ে দিয়ে গিয়েছে।

বাঘা যতীন থেকে চ্যাটার্জি ইন্টারন্যাশনালে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে আসা মধুরিমা মহাজন এখনও ভুলতে পারছেন না, চোদ্দোতলায় বসে কী ভাবে চোখের সামনে অফিসের ডেস্কটপ উল্টে মেঝেয় পড়তে দেখেছেন। নিজেও সিঁড়িতে হোঁচট খেয়ে চোট পেয়েছেন। রহড়াবাজারে প্রগতি মাইতির নতুন ফ্ল্যাটের মার্বেলেও গভীর ক্ষত।

তিলজলার ব্রজনাথ বিদ্যাপীঠের মাস্টারমশাই সূর্যকুমার ত্রিপাঠী মৃদু হৃ‌দ‌রোগের ভয় পেয়েছিলেন। বুক ধড়ফড়িয়ে উঠল কেন ভাবতেই দেখেন, ক্লাসের টেবিল-চেয়ার সব দুলছে। ছাত্রদের বেরোতে বলে নিজেই স্কুলের ছুটির ঘণ্টার বাজিয়ে দেন। পরে টের পান দোতলায় ল্যাবরেটরির দেওয়ালের একাংশ ভেঙে পড়েছে।

বালিগঞ্জের পাল-বাড়িতে অঞ্জন দত্তের ব্যোমকেশ ছবির শ্যুটিং চলাকালীনও আতঙ্ক ছড়ায়। পরিচালক স্বয়ং শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, যিশু সেনগুপ্ত, ঊষসী চক্রবর্তী-সহ ইউনিটের সবাইকে নিয়ে শ্যুটিং থামিয়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে পড়েন। টিভি স্টুডিওয় ভোটের জমাটি আলোচনা চলতে চলতেই হঠাৎ কম্পমান ক্যামেরা, সরঞ্জাম। অতিথিরা বেগতিক দেখে গলায় মাইকের ল্যাপেল খুলে বেরিয়ে পড়ার উপক্রম করেন। কম্পন-আতঙ্কে বেশ কয়েকটা এলাকায় ভোটাররা বুথমুখো হচ্ছেন না বলেও গোড়ায় খবর গিয়েছিল নির্বাচন কমিশনের কাছে।

দুপুরের মধ্যেই শহরের বেশ কয়েকটি অফিস ও দোকানপাট ঝাঁপ বন্ধ করে দেয়। ভূমিকম্প থামার আপাত স্বস্তিতে শহরের গুমোট মেজাজ খানিকটা ফিকে হতে কিছুক্ষণের জন্য ফুরফুরে মেজাজে ফিরেছিল কলকাতা। বিকেলের দিকে প্রায় জনহীন অফিসে বসে কানে গান গুঁজে কফি খেতে খেতে ফেসবুকে স্টেটাস দিয়েছেন বেসরকারি সংস্থার কোনও কোনও কর্মী। কম্পন-কাণ্ড নিয়ে তৃণমূল ও সিপিএম সমর্থকদের উতোর-চাপানও এ দিন নেটের খোরাক। কেউ বলেছেন, ভোটের গতিবিধি দেখেই বিরোধীরা থরহরি কম্পমান। কারও পাল্টা, দুর্নীতিতেই মা ও মানুষের পরে মাটিও এ বার কাঁপছে। শান্তিনিকেতন বিল্ডিংয়ের তেরোতলায় দেওয়ালে ফাটলের ছবি তুলে হোয়াট্‌স অ্যাপে সহকর্মীদের পাঠানোর সময়ে কেউ কেউ ইচ্ছে করে হাতে চায়ের কাপ নাচিয়ে ‘এখনও কাঁপছে’ বলে বার্তা পাঠিয়েছেন।

তবে ক্রমশ সামগ্রিক বিপর্যয়ের বহরটা জানাজানি হতেই ফের পাল্টে যায় শহরের মেজাজ। সোশ্যাল মিডিয়াতেই দুর্গতদের পাশে দাঁড়িয়ে কিছু করার ডাক ওঠে। নেপালের ধ্বংসলীলার অজস্র ছবি তত ক্ষণে নেট-রাজ্যে পর পর আছড়ে পড়েছে।

শনিবার ছবিগুলি তুলেছেন বিশ্বনাথ বণিক,

সম্রাট মুখোপাধ্যায় ও স্বাতী চক্রবর্তী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন