পুর নিগমের ভোট

‘সব চাই’ বনাম ‘আমরাও আছি’

পুর-নিগমের নির্বাচন হলেও রাজনৈতিক গুরুত্বের বিচারে বিধানসভা নির্বাচনের মহড়া। শাসক দল তৃণমূল এবং প্রধান বিরোধী সিপিএম উভয়ের কাছেই বিধাননগর পুর-নিগমের এই নির্বাচন তাই এক অর্থে মর্যাদার লড়াই। ‘মর্যাদা’ রক্ষার মাপকাঠি অবশ্য শাসক এবং বিরোধীর ক্ষেত্রে আলাদা। বিধাননগর এবং রাজারহাট-গোপালপুর, দুই পুরসভাকে মিলিয়ে নবগঠিত বিধাননগর পুর-নিগমের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করা তৃণমূলের কাছে জরুরি।

Advertisement

কাজল গুপ্ত ও প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০১৫ ০০:২০
Share:

রণাঙ্গনে নানা রং। বুধবার, কৈখালিতে। ছবি: শৌভিক দে

পুর-নিগমের নির্বাচন হলেও রাজনৈতিক গুরুত্বের বিচারে বিধানসভা নির্বাচনের মহড়া। শাসক দল তৃণমূল এবং প্রধান বিরোধী সিপিএম উভয়ের কাছেই বিধাননগর পুর-নিগমের এই নির্বাচন তাই এক অর্থে মর্যাদার লড়াই।
‘মর্যাদা’ রক্ষার মাপকাঠি অবশ্য শাসক এবং বিরোধীর ক্ষেত্রে আলাদা। বিধাননগর এবং রাজারহাট-গোপালপুর, দুই পুরসভাকে মিলিয়ে নবগঠিত বিধাননগর পুর-নিগমের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করা তৃণমূলের কাছে জরুরি। আর সিপিএমের কাছে জরুরি হল, আগামী বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিরোধী হিসেবে মাথাচাড়া দেওয়া। উত্তরবঙ্গে শিলিগুড়ি পুর-নির্বাচনের মতো দক্ষিণবঙ্গে কলকাতা ঘেঁষা এই পুর-নিগমের ভোটে নিজেদের অস্তিত্ব জাহির করে রাজনৈতিক ফায়দা তোলা।
পাঁচ বছর আগে বিধাননগর পুরসভা সিপিএমের থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার পরে ২০১১-র বিধানসভাতেও তৃণমূল এই এলাকার সবক’টি আসন দখল করে। কিন্তু ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে মোদী-হাওয়া লেগেছিল সল্টলেকে। সেখানে বিজেপি-র কাছে ছ’হাজারেরও বেশি ভোটে পিছিয়ে গিয়েছিল রাজ্যের শাসক দল। পাশাপাশি রাজারহাট-গোপালপুর পুরসভাও ছিল সিপিএমের হাতে। এ বার নবগঠিত পুর-নিগমের প্রথম নির্বাচনে মোট ৪১টি আসনের মধ্যে ‘সবগুলিই’ তাঁর চাই বলে দলের নেতাদের কাছে নির্দেশ দিয়েছেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জান-প্রাণ লড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতার সেই নির্দেশ কার্যকর করা এখন তাই তৃণমূলের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
সেই পথ ‘মসৃণ’ করার জন্য ইতিমধ্যেই রাজারহাট-গোপালপুরের প্রাক্তন পুর-চেয়ারম্যান ও এলাকার প্রভাবশালী সিপিএম নেতা তাপস চট্টোপাধ্যায়কে ভাঙিয়ে আনতে পেরেছে তৃণমূল। তবু অস্বস্তির কাঁটা ওই এলাকায় শাসক দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব এবং সিন্ডিকেট-রাজ। পুর-নির্বাচনে এই কাঁটা তুলে ফেলতে না পারলে বিধানসভা ভোটে যে দলকে বেগ পেতে হবে, সেটা বুঝে এলাকায় তৃণমূলের বিভিন্ন গোষ্ঠী নেতাকে নিয়ে বৈঠক করেছেন মমতা স্বয়ং। প্রকাশ্যে এবং দলের অন্দরে বারবার বার্তা দিয়েছেন ‘ঐক্যবদ্ধ’ ভাবে লড়াই করার। পুর-নিগমের প্রার্থী বাছাইয়েও স্থানীয় বিধায়কদের নিজ নিজ এলাকায় গুরুত্ব দিয়ে কৌশলে তাঁদের নিজেদের এলাকার কাউন্সিলরদের জেতানোর ‘দায়’ কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছেন। উদ্দেশ্য, বিধায়ক তাঁর নিজের ‘স্বার্থে’ এলাকার কাউন্সিলরদের জিতিয়ে আগামী বিধানসভা ভোটের আগে নিজের ভিত মজবুত রাখবেন। একই সঙ্গে তৃণমূলের নেতৃত্বে রাজারহাট-নিউ টাউনের বিস্তীর্ণ এলাকায় ‘সিন্ডিকেট রাজ’ নিয়ে যে সব অভিযোগ উঠেছে, মারামারি হয়েছে, এই ভোট জিতে তাতেও জল ঢেলে দেওয়ার ‘সুযোগ’ তৈরি করতে চাইছে দল। অনেকের মতে, বাস্তবটা কিন্তু ভিন্ন। আসলে বিধানসভা ভোটের আগে ‘কোটি কোটি টাকার সিন্ডিকেট সাম্রাজ্যে’ নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা বজায় রাখা যে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, তৃণমূল তা জানে। যদিও সিন্ডিকেট এবং গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নস্যাৎ করতে পার্থ চট্টোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিম, অভিযেক বন্দ্যোপাধ্যায়দের বারবার বলতে হয়েছে, তৃণমূলে সিন্ডিকেট নেই, দলাদলিও নেই। সবাই এক ছাতার তলায়— তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisement

সিপিএমের চ্যালেঞ্জটা অন্য রকম। দল যে কিছুটা ‘ব্যাকফুটে’ লড়াই শুরু করেছে, নেতৃত্ব তা বোঝেন। কিন্তু শিলিগুড়ির পুর-নির্বাচনে জিতে দলের অন্দরে যেটুকু চনমনে ভাব, সেই রেশ ধরে রেখে এই ভোট লড়ার অক্সিজেন পেতে চেয়েছে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। যদিও প্রচারে-প্রভাবে আপাতদৃষ্টিতে তৃণমূলের থেকে তারা পিছিয়ে। তবু শিলিগুড়ি মডেলে নির্বাচনে সর্বদলীয় নজরদারি চালাতে বিরোধীদের উদ্যোগে এক দল বিশিষ্টকে নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘সিটিজেন্স ফোরাম’। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র প্রকাশ্যে জানান— যদি কেউ ভোট দিতে বাধা পান, তবে ঝান্ডার রং না দেখে সকলে মিলে প্রতিবাদে নামতে হবে। অভিযোগের তির তৃণমূলের ‘সন্ত্রাস’-এর দিকে। নির্বাচনী প্রচারে সিপিএম-বিজেপি-কংগ্রেস সবারই যা মূল কথা।

সল্টলেক বা রাজারহাটে নির্বাচনী সন্ত্রাস অবশ্য কোনও নতুন ঘটনা নয়। যে যখন ক্ষমতায়, সন্ত্রাসের অভিযোগ তখন উঠেছে তার বিরুদ্ধে। সিপিএম-ও সেই ‘কলঙ্ক’ থেকে মুক্ত নয়। এখন তৃণমূল ক্ষমতায়, তাই পুলিশকে ‘নিষ্ক্রিয়’ রেখে বহিরাগতদের দিয়ে ‘ভোট লুঠ’ করানোর আগাম আশঙ্কায় নির্বাচনী বাজার গরম করে দিয়েছে সব বিরোধী দল। রাজনৈতিক অঙ্কে যেহেতু আপাত ভাবে তৃণমূলের পাল্লা ভারী, তাই বিরোধীদের ওই সব অভিযোগকে ‘নিশ্চিত পরাজয়ের’ অজুহাত বলে পাল্টা যুক্তি দিচ্ছে শাসক দল।

Advertisement

এই চাপান-উতোর সরিয়ে রাখলেও বিরোধী শিবিরের ছবিটা খুব উজ্জ্বল বলা চলে না। ২০১৪-র মোদী-হাওয়া কাটিয়ে বিজেপি এখন সারা রাজ্যেই দৃশ্যত স্তিমিত। বিধাননগর ব্যতিক্রম হবে কেন? কংগ্রেসের অবস্থাও তথৈবচ। সিপিএম আগের চেয়ে খানিকটা ‘জীবন্ত’। আসরে ভোট পরিচালনার প্রধান মুখ হয়েছেন গৌতম দেব। তবে বিধাননগর পুর-নিগমের এই নির্বাচনে তাদের অন্তত দু’টি ক্ষেত্রে বড় ধাক্কা সহ্য করতে হয়েছে। এক, রাজারহাটে ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপ’ তাপস চট্টোপাধ্যায়ের সদলবলে তৃণমূলে যোগদান। দুই, প্রার্থী তালিকা প্রকাশের পরে নির্বাচন থেকে দীর্ঘদিনের প্রবীণ নেতা ও প্রাক্তন বিধায়ক রবীন মণ্ডলের সরে দাঁড়ানো। মেয়র পদে সিপিএমের পছন্দের প্রার্থী প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত এর আগে ২০১১-র বিধানসভা ও ২০১৪-র লোকসভা, দুই নির্বাচনেই পরাজিত। প্রার্থী হিসেবে প্রয়াত সিপিএম মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীর স্ত্রী রমলা চক্রবর্তীও হেভিওয়েট।

এটুকু বাদ দিলে বাকি দুই বিরোধী বিজেপি এবং কংগ্রেস সম্পর্কে খুব বেশি আশার কথা তাদের নিজেদের শিবিরেও শোনা যায় না। তবে ভোটের হাওয়ায় ‘সন্ত্রাসের’ গুঞ্জন ক্রমশ ছড়াচ্ছে। তাই ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকবে না, এমন আশঙ্কা থেকেই তৈরি হচ্ছে নানা প্রশ্ন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
আরও পড়ুন