মানুষকে ভোলাতেই কি এত সব আয়োজন? প্রশ্ন অনীকের

সরকারি চাকুরেদের নিয়ে আগে একটা মজার কথা চালু ছিল— ‘আসব যাব, মাইনে নেব।’ এখন উৎসবের বহর যে ভাবে বেড়ে চলেছে, তাতে আসা-যাওয়ার কষ্টটাও আর করতে হচ্ছে না তাঁদের! বাড়ি বসেই মাইনে হাতে আসছে। ব্যাপারটা প্রথম প্রথম বেশ ভাল লাগবে, কোনও সন্দেহ নেই।

Advertisement

অনীক দত্ত (পরিচালক)

শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০১৮ ০২:৪৫
Share:

ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য

আজকালকার ছোট ছোট ছেলেপুলেদের দেখলে ভারী ঈর্ষা হয় আমার! সরকারি চাকুরেদের দেখলেও মাঝেমাঝে হয়। উৎসবের ঠেলায় তাঁদের স্কুল-কলেজ-অফিস যাওয়ার পাট প্রায় চুকেই গিয়েছে। রোজই ছুটি!

Advertisement

সরকারি চাকুরেদের নিয়ে আগে একটা মজার কথা চালু ছিল— ‘আসব যাব, মাইনে নেব।’ এখন উৎসবের বহর যে ভাবে বেড়ে চলেছে, তাতে আসা-যাওয়ার কষ্টটাও আর করতে হচ্ছে না তাঁদের! বাড়ি বসেই মাইনে হাতে আসছে। ব্যাপারটা প্রথম প্রথম বেশ ভাল লাগবে, কোনও সন্দেহ নেই। পড়ে-পাওয়া ছুটির দিনে বই পড়ে, আড্ডা মেরে আর মাংস-ভাত খেয়ে কাটাতে কে না চায়! বিরোধীরাও একদম জব্দ! বন্‌ধ ডাকার কোনও সুযোগই নেই। রোজই তো ছুটি। ব্যাপারটা কিন্তু ভারী মজার। মোচ্ছবে মোচ্ছবেই ছয়লাপ।

কিন্তু দিনের পর দিন এই জিনিস চলতে থাকলে মাইনে পাওয়াটা নিশ্চিত করতে পারবেন তো? বারো মাসে তেরোশো পার্বণের গুঁতোয় যে ভাবে কর্মদিবসের সংখ্যা ক্রমশ কমছে, তাতে অচিরেই সরকারি রাজস্বে টান পড়বে। তখন চাকুরেদের ডিএ-পেনশন তো বটেই, মাইনে নিয়েও টানাটানি হতে বাধ্য। সে কথা আমরা, মানে আমজনতা বুঝতে পারছি কি?

Advertisement

আরও পড়ুন: সেরার দৌড়ে পশ্চিমবঙ্গ, ছুটিতে ধারেকাছে নেই প্রায় কেউই!

বিপণন জগতের দৌলতে বছরভর বিভিন্ন দিন পালনের ধুম যে ভাবে বেড়েছে, তার সঙ্গেই পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে উৎসবের সংখ্যা। বেড়েই চলেছে। অনেকে মজা করে আজকাল বলেন, সামনের বছর পুজোর ছুটি হবে এক মাস! যা অবস্থা, তাতে অচিরেই এই ভবিষ্যদ্বাণী সত্যি হতে চলেছে মনে হয়। প্রতি বার কোনও উৎসব পালনের আগে ক্যুরিয়রের এক ভদ্রলোক সরকারি আমন্ত্রণপত্র নিয়ে আমার বাড়িতে আসেন, আর প্রতি বারই আমি টিপ্পনী কাটি, ‘‘কী! আবার!’’ উনি হেসে ফেলে বলেন, ‘‘হোক হোক, যত উৎসব তত ভাল।’’ এই সমস্ত উৎসব পালনের ছুতোয় ওঁর মতো আরও অনেকের রোজগার হয় এবং কর্মসংস্থান যে বাড়ে, এ কথা সত্য। কিন্তু উৎসব-মোচ্ছবের বাড়বাড়ন্তে অর্থনীতির কী হাল হবে, তা কি আমরা আন্দাজ করতে পারি? কলেজের খাতায় অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে আমার নাম লেখানো ছিল ঠিকই, তবে এই বিশ্লেষণ করার দক্ষতা আমার নেই বলেই মনে করি। তবে, যে কোনও অর্থনীতিবিদই বলবেন, কোনও জিনিসই বল্গাহীন ভাবে বেড়ে গেলে তার একটা নেতিবাচক প্রভাব আসতে বাধ্য। উৎসবও কিন্তু এই নিয়মের বাইরে নয়।

আরও পড়ুন: অঢেল ছুটির নিমন্ত্রণ, তবু সকলেই আহ্লাদিত হন না যে

এই সমস্ত উৎসবের একটা ধর্মীয় মুখ রয়েছে। ফলে রেষারেষি লেগে যাওয়াও বিচিত্র নয়। উৎসবের নামে, ধর্মের নামে শুরু হয়ে গিয়েছে দরাদরিও! আর এই উৎসব তো এখন ভোটব্যাঙ্ক আরও পোক্ত করার হাতিয়ার। যে সম্প্রদায় বহরে যত বেশি, তাদের তত খুশি রাখো! সব ভাষাভাষী মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলতে বাধ্য হচ্ছি, এই যে ছটপুজো ঘিরে আজকাল এত মাতামাতি, সরকারি ছুটির ঘোষণা— এ সব কয়েক বছর আগেও ছিল কি? কাজেই সহজেই অনুমেয়, এ ভাবেই মানুষকে খুশি করতে চাইছেন রাজনীতিকেরা। সেই সঙ্গে উৎসবের আবহে বড় বড় ছবি, কাটআউট— নিজেদের প্রচারের কাজটাও সুকৌশলে সেরে ফেলা যায়! অর্থাৎ, এক ঢিলে দুই পাখি।

কয়েক বছর আগে আমেরিকার শার্লট শহরে অল্প কিছু দিন ছিলাম। গ্রাম্য স্মৃতি ধরে রাখতে সপ্তাহে এক দিন একটি রাস্তা বন্ধ করে হাট বসায় ওরা। অবাক হয়ে দেখেছিলাম, রাতারাতি স্টল বসিয়ে, রাস্তা সাজিয়ে সেই হাট তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আবার রাত বাড়তেই সব কিছু গুটিয়ে ফেলার সে কী তাড়া! পরদিন সকালে রাস্তা একদম সাফ! কে বলবে, আগের দিনই সেখানে ছিল উৎসবের আমেজ। আমরা অবশ্য এ সব কিছু ওদের দেখে শেখার ধার ধারি না। তাই পুজোআচ্চা, উৎসব-মোচ্ছবের জেরে দিনের পর দিন ব্যাহত হয় জীবন ও জীবিকা, জরুরি পরিষেবা। পুজোর পরেও দিনের পর দিন প্রতিমার মণ্ডপে বসে থাকা, বিসর্জনের আগে নতুন কার্নিভাল, গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাঘাট আটকে রেখে মাসাধিক কাল মণ্ডপ রেখে দেওয়া আর তার জেরে যানজট— আস্তে আস্তে এ সবে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি আমরা। যেন এমনটাই হওয়া উচিত! এমনটাই নিয়ম!

আরও পড়ুন: কেউ কেউ বলছেন এ বার আমাকে ভাতে মারা হবে, মারবে, রুটি খাব

তাই মাঝেমধ্যে মনে হয়, এই উৎসব-মোচ্ছবের বাড়বাড়ন্ত আদতে সাধারণ মানুষকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা নয় তো? এক সময়ে কর্মসূত্রে চা-বাগানে থাকতে হয়েছিল আমাকে।

সেখানে দেখেছিলাম, সাপ্তাহিক মাইনেটা হাতে পেয়েই পুরুষকর্মীরা গিয়ে লাইন দিতেন পাশের চোলাই মদের দোকানে। প্রশ্ন করায় জবাব পেয়েছিলাম, ‘‘এইটুকু মাইনেতে কি আর সংসার চলে বাবু! না কি পেট ভরে! তাই মদ খাই। ওটা যে কিছু ক্ষণের জন্য হলেও সব কিছু ভুলিয়ে রাখে। বাঁচিয়ে রাখে।’’ উৎসব-মোচ্ছবও ক্রমশ আমাদের কাছে সেই আফিম হয়ে উঠছে। হয়ে উঠছে সমস্যা থেকে পালিয়ে যাওয়ার ছুতো। বর্তমান সরকারও কিন্তু সেই প্রবণতার ফাঁদে পা দিচ্ছেন। তাই তো সরকারি চাকুরেদের হকের ভাতা না দিয়ে বাড়ানো হচ্ছে ছুটির সংখ্যা। উৎসব-মোচ্ছবের উদ্দেশ্যই এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে দুটো— রাজনৈতিক প্রচার আর মানুষকে ভুলিয়ে রাখা।

অনেক বড় বড় তারকার মধ্যেও মাঝেমধ্যে হীনম্মন্যতা কাজ করে, জানেন তো! তাঁরা মনে করেন, এই বুঝি তাঁর নাম-যশ-প্রতিপত্তি সব চলে গেল! সরকারের ক্ষেত্রেও হয়তো সেটাই হয়েছে, তাই এত উৎসব পালনের ধুম। তবে অনেকেই যে এটা ভাল চোখে দেখছেন না, সেটাই ভরসার কথা। তাঁদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়লে সরকারও হয়তো এক দিন বুঝবে যে, জনমোহিনী এই মোচ্ছবের রাস্তা আসলে জনমতের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। সে দিন হয়তো বল্গাহীন এই উৎসবের আবহে রাশ টানা হবে।

সেই দিন যত তাড়াতাড়ি আসে, ততই মঙ্গল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন