Kolkata Metro Service

‘এ বার কী হবে?’ রাত্রিকালীন মেট্রোর শেষযাত্রায় দিশেহারা যাত্রীদের প্রশ্নে লাগাতার বিদ্ধ দমদম থেকে চাঁদনি চকের সফর

যাত্রীদের ক্ষোভ রাতের মেট্রোর ভাড়া নিয়েও। তাঁদের কথায়, ‘‘১০ টাকা করে ভাড়া বাড়িয়েছিল। তার পরেও তো খুব একটা কম ভিড় হচ্ছিল না। কেন তবে এই পরিষেবা বন্ধ করে দিল মেট্রো?’’

Advertisement

কমলিকা ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৬:৫১
Share:

দমদম স্টেশনে রাতের শেষ মেট্রোয় উঠতে চলেছেন যাত্রীরা। — নিজস্ব চিত্র।

এ যেন ‘বিনা মেঘে বজ্রপাত’! মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আচমকা মেট্রোর রাত্রিকালীন পরিষেবা বাতিলের কথা শুনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। একটাই প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, ‘‘এ বার কী হবে!’’

Advertisement

শ্যামনগর থেকে প্রতি দিন চাঁদনি চকের অফিসে আসি। রাতের ডিউটি থাকে। রাত ১১টায় ঢুকতে হয়। শ্যামনগর থেকে ট্রেনে দমদম, সেখান থেকে ১০টা ৪০ মিনিটের মেট্রো ধরে অফিস পৌঁছোতে মেরেকেটে লাগে এক থেকে সওয়া এক ঘণ্টা। কিন্তু বুধবার থেকে কত ক্ষণ লাগবে, ভেবেই মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। শ্যামনগর থেকে শিয়ালদহ, সেখান থেকে বাস ধরে চাঁদনি— লম্বা পথে অফিসে যাওয়ার ঝঞ্ঝাট আমার কাছে বিভীষিকা!

মেট্রো বলছে, রাতের ট্রেনে লোক হচ্ছে না। তাই পরিষেবা পুরোপুরি বন্ধ। এ কেমন কথা? মঙ্গলবার রাতে আমার কামরাতেই কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বুঝলাম, মেট্রোর এই ‘হঠকারী’ সিদ্ধান্তে খুশি নন কেউ। তাঁরা বলছেন, রাতের এমনি ট্রেনেও তো যাত্রী কম হয়। তা বলে সেটা কি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে? না কি হবে? ভেবে দেখলাম, ঠিকই তো। রেল, মেট্রো— সবই তো সরকারের। আর সরকারই যদি এ ভাবে হাত তুলে নেয়, তবে তো মুশকিল!

Advertisement

আমার চিন্তার কারণ অবশ্য একটাই— শিয়ালদহে নেমে রাতে অফিস যাওয়ার বাস পাব তো? না পেলে তো ওলা-উবর-র‌্যাপিডো ভরসা। রাতে কত টাকা উঠবে জানা নেই। ক্যাব বা বাইক না পেলে ট্যাক্সি ধরতে হবে। সে তো এখন আর এক আতঙ্ক। হয় মুখের উপর বলে দেবে, যাব না। নয়তো আকাশছোঁয়া ভাড়া চাইবে। এ বিপদ যদি মেট্রো বুঝত!

মঙ্গলবার দমদম স্টেশনে রাত্রিকালীন মেট্রোর অপেক্ষায় যাত্রীরা। — নিজস্ব চিত্র।

দেখলাম, আমার মতোই আফসোস করছেন টালিগঞ্জের বাসিন্দা রিয়া দত্ত। রোজ আমার মতোই রাতে দমদম থেকে ১০টা ৪০ মিনিটের মেট্রো ধরেন। এক বছর ধরে প্রায় রোজই একসঙ্গে যাতায়াত করতে করতে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। কয়েকটা স্টেশন একসঙ্গে আসতাম। মঙ্গলবার আমার কাছে শেষ মেট্রো বন্ধের কথা শুনে দিশাহারা রিয়া। বলছিলেন, ‘‘কাল (বুধবার) থেকে খুব সমস্যায় পড়ব।’’ তাঁরও প্রশ্ন, ‘‘রাতের মেট্রোয় তো ভালই ভিড় হয়। তবে কেন বন্ধ করছে?’’ আদৌ যাত্রীর সংখ্যা কম হওয়া কারণ? না কি অন্য কিছু? আমাদের কথোপকথন শুনে পাশ থেকে এক যাত্রী বলে উঠলেন, ‘‘আরে না না! ও সব কিছু নয়। সব ফালতু যুক্তি মেট্রোর। আসলে আমাদের ঢাল করে অন্য কিছু লুকোতে চাইছে।’’ তাই কি? কে জানে!

রিয়ার মতো রাতের মেট্রোতেই আলাপ অশোককুমার পালের সঙ্গে। গিরিশ পার্ক থেকে দমদমে তাঁর দোকানে আসেন। গত এক বছর ধরে রাতে দমদমের দোকান বন্ধ করে ১০টা ৪০ মিনিটের মেট্রো ধরতেন। বুধবার থেকে বাড়ি ফেরার ঝক্কির কথা বলতে বলতে শুধু মাথা নাড়ছিলেন। সঙ্গে স্বগতোক্তি, ‘‘১০টার পরে দমদম থেকে বাস পাওয়া যায় না। অটো-অটো করে শ্যামবাজার যাওয়া যাবে। কিন্তু তার পর?’’

আমার মতোই অরিত্রের অফিসও চাঁদনিতেই। পদবিটা এত দিনেও জানা হয়নি। দমদম থেকে শেষ মেট্রোয় চেপে নাইট ডিউটি করতে আসতেন। তবে তাঁর একটা ‘পক্ষীরাজ’ আছে। মানে মোটরবাইক। মেট্রো বন্ধ হলে বাইকের উপরেই ভরসা করতে হবে অরিত্রকে। তবে পেট্রলের যা দাম! সে চিন্তাও ঘুরপাক খাচ্ছে তাঁর মাথায়।

এত লোকের কথা শুনে আরও ভারাক্রান্ত লাগছিল। শেষ বারের জন্য মঙ্গলবার রাত্রিকালীন মেট্রোয় উঠলাম। ট্রেনেও ইতিউতি একই আলোচনা। শ্যামবাজার থেকে ওঠা এক মহিলা যাত্রী আলোচনার মাঝপথে তাঁর প্রশ্নমালা নিয়ে আমার কাছে হাজির হলেন। রাতের পরিষেবা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে? কবে থেকে? আপনাকে কে বলল? এ বার কী হবে? প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতেই দেখলাম, চাঁদনি চক এসে গিয়েছে। নামতে হবে। হুড়োহুড়িতে তাঁর নামটাও জানা হয়নি। আমার কাছে তিনি নামহীন যাত্রী হয়েই থেকে গেলেন। আর তো এই মেট্রোয় ওঠা হবে না। দেখাও হবে না। শুনছিলাম, যাত্রীদের ক্ষোভ রাতের মেট্রোর ভাড়া নিয়েও। তাঁরা বলছিলেন, ‘‘১০ টাকা করে ভাড়া বাড়িয়েছিল। তার পরেও তো খুব একটা কম ভিড় হচ্ছিল না। কেন তবে এই পরিষেবা বন্ধ করে দিল?’’ কারও প্রশ্ন, ‘‘মাত্র এক দিনের নোটিসে কেন পরিষেবা বন্ধ করা হল?’’ চার পাশে শুধু কেন, কেন, কেন! যার কোনও উত্তর তখন নেই আমার কাছে।

মঙ্গলবারের রাতের মেট্রোর আলোচনায় যোগ দিয়েছিলেন এক মেট্রোকর্মীও। স্বাভাবিক যে তিনি নিজর নাম-পরিচয় বলতে চাইলেন না। বুকে সাঁটা ব্যাজে নাম দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু তাঁর অনুরোধেই নামটা লিখলাম না। তিনিও মেনে নিলেন, মেট্রো কর্তৃপক্ষ এটা ঠিক করেননি। তাঁর কথায়, ‘‘নতুন জিএম এসে এই নিয়ম করেছেন। মেট্রোয় স্টাফ (কর্মী) কম। এক এক জনকে ১২-১৪ ঘণ্টা ডিউটি করতে হয়।’’ শুনে মনে পড়ল দমদম স্টেশনের সহযাত্রীর কথা, যিনি বলেছিলেন, ‘‘আমাদের ঢাল করে অন্য কিছু লুকোতে চাইছে মেট্রো।’’ তবে কি কর্মী কম থাকায় রাতের পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হল?

বিভিন্ন প্রশ্নের ভারে আরও ভারাক্রান্ত লাগছিল। পাশে বসা এক যাত্রীর মোবাইলে দেখলাম জ্বলজ্বল করছে আনন্দবাজার ডট কম-এর প্রথম পাতা। শিরোনাম, ‘কলকাতাকে আবার ‘নাবালক’ বানিয়ে দিল মেট্রো’।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement