নেশাই গ্রাস করল প্রাণটা, বলছে পরিবার

অমিতের পরিজনেরাই জানালেন, এক সময়ে মুদির দোকানে কাজ করতেন অমিত। পরে একটু একটু করে পয়সা জমিয়ে লর্ডসের মোড়ে একটি মুরগির মাংসের দোকান খোলেন। সে সময়েই বন্ধুদের পাল্লায় প়ড়ে মাদকের নেশায় হাতেখড়ি। গাঁজা, চরস থেকে হেরোইন, ক্রমেই বাড়ছিল নেশার বহর।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০১:৫৯
Share:

অমিত রায়

শ্বশুরবাড়িতে থাকা স্ত্রীকে ফোন করে বা়ড়িতে ফিরে আসতে বলেছিলেন তিনি। স্বামীর কথা মেনে ফিরেও এসেছিলেন বছর বাইশের সুনয়না। কিন্তু এসে দেখেন, দরজা বন্ধ। প্রতিবেশীদের নিয়ে ভিতরে ঢুকতেই দেখেন, গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলছেন স্বামী অমিত রায়। ঘরের দেওয়ালে রক্ত দিয়ে লেখা ‘আই কুইট’।

Advertisement

রবিবারের এই ঘটনা কোনও দাম্পত্য কলহের পরিণাম নয়। বরং স্ত্রী ও তিন বছরের ছেলেকে ছে়ড়ে অমিতের এ ভাবে ‘পালানো’র পিছনে রয়েছে এক মারণ নেশার কাহিনি। যে নেশার চক্করে পড়ে মুদি দোকানের কর্মচারী থেকে মুরগির দোকানদার হয়ে ওঠা এক যুবক অচিরেই পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নেন।

অমিতের মৃত্যুর খবর চাউর হতেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল যাদবপুর থানা এলাকার প্রিন্স গোলাম মহম্মদ শাহ রোড। স্থানীয় যুবক সঞ্জীব ওরফে হুলোর দোকান ভাঙচুর করে আগুন লাগানো হয়। মারধর করা হয় পুলিশকেও। রাতে বিরাট পুলিশবাহিনী গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। সোমবার অবশ্য থমথমে ছিল ওই এলাকা।

Advertisement

অঝোরে: স্বামী অমিত রায়ের মৃত্যুর পরে ভেঙে পড়েছেন তাঁর স্ত্রী সুনয়না। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

এ দিন রংকল বস্তিতে গিয়ে দেখা গেল, সিঁথি ভর্তি সিঁদুর, পায়ে আলতা পরে বসে সুনয়না। শোক বিধ্বস্ত শরীরে রাত জাগার ক্লান্তির ছাপ। পাশে এক মহিলার কোলে তিন বছরের ছেলে। সেখানে গিয়েই শোনা গেল, অমিতের এ ভাবে চলে যাওয়ার ঘটনা।

অমিতের পরিজনেরাই জানালেন, এক সময়ে মুদির দোকানে কাজ করতেন অমিত। পরে একটু একটু করে পয়সা জমিয়ে লর্ডসের মোড়ে একটি মুরগির মাংসের দোকান খোলেন। সে সময়েই বন্ধুদের পাল্লায় প়ড়ে মাদকের নেশায় হাতেখড়ি। গাঁজা, চরস থেকে হেরোইন, ক্রমেই বাড়ছিল নেশার বহর। নেশার সূত্রেই হুলোর সঙ্গে বন্ধুত্ব বা়ড়ে। শুরু হয় পরিবারে অশান্তিও। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। ধোঁয়ার বদলে শুরু হয় সিরিঞ্জে করে শিরায় মাদক রসের চালান।

সুনয়না জানান, পরিবারে অশান্তি বাড়তে থাকে, ব্যবসাও লাটে ওঠে। যেটুকু আয় হত, পুরোটাই চলে যেত নেশায়। পরে অবশ্য নিজের
ভুল বুঝতে পেরেছিলেন অমিত। নেশা ছাড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু নেশা তাঁকে ছাড়েনি। পরিবারের লোকেরা জানিয়েছেন, নেশামুক্তির জন্য সোনারপুরের একটি কেন্দ্রেও ভর্তি হয়েছিলেন অমিত। কয়েক দিন থেকে বাড়ি ফিরে আসেন। ফের পা বাড়ান মাদকের দুনিয়ায়।

নিজের ঘরের দেওয়ালে এ ভাবেই রক্ত দিয়ে অপারগতার কথা জানিয়ে গিয়েছেন ওই যুবক। সোমবার, যাদবপুরের প্রিন্স গোলাম মহম্মদ শাহ রোডে। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য

এ সবের পিছনে এখন হুলোকেই দুষছেন এলাকাবাসী। তাঁদের অভিযোগ, সামনে চায়ের দোকান চালালেও দীর্ঘদিন ধরেই সেখানে গোপনে মদ বিক্রি হত। এলাকার মানুষজন প্রতিবাদ করায় সেটি বন্ধ করে দেয় সে। তার বদলে শুরু করে গাঁজা, চরস, হেরোইনের কারবার। পুলিশ বলছে, হুলো
নিজেও মাদকাসক্ত। কয়েক বার হাজতে গিয়েছে সে। পুলিশ তাকে নেশামুক্তি কেন্দ্রে ভর্তি করে দিলেও সেখান থেকে বারবার পালিয়েছে হুলো। এই মাদক কারবারের হালহকিকতও ভাল জানত সে। তাই একেবারেই অল্প পরিমাণে মাদক রাখত। ফলে ধরা পড়লেও বেশি দিন জেল খাটতে হত না তাকে। বস্তির এক বাসিন্দা বলছেন, ‘‘হুলোর এমনই পরিচিতি ছিল যে অনেক ব়ড়লোক পরিবারের ছেলে-মেয়েরাও গাড়ি চেপে ওর দোকানে আসত।’’

এলাকার বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, গোলমাল দেখেই চম্পট দিয়েছে হুলো। তার বাড়িতে তালা ঝুলছে। খোঁজ মিলছে না তার স্ত্রীয়েরও। পুলিশ কেন সব কিছু জেনেও এত দিন কোনও ব্যবস্থা নেয়নি, তা নিয়েই রবিবার রাতে উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন বস্তিবাসীরা। যদিও পুলিশের দাবি, বারবার হুলোকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ওই বস্তিতে মাদকবিরোধী প্রচারও করা হয়েছে বহুবার। ভবিষ্যতে আরও জোরালো প্রচার এবং মাদকবিরোধী অভিযানে নামার কথা জানিয়েছেন পুলিশকর্তারা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন