Calcutta News

শহর সাজবে ওঁদের জরি আর নাগরার কারুকাজে

মহাজাতি সদনের পিছনে মার্কাস স্কোয়ার সংলগ্ন এই এলাকার কয়েক ঘরে এ ভাবেই চলছে রমজান মাসের শেষে খুশির ইদের প্রস্তুতি। হাতে মাত্র দিন সাতেক।

Advertisement

জয়তী রাহা

শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০১৮ ০২:৪৭
Share:

একমনে: কাপড়ের উপরে চলছে সোনালি জরির বুনন।

গলি, তস্য গলি পেরিয়ে ঘিঞ্জি এলাকা। তারও পরে এঁদো গলি পেরিয়ে পাকা বাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে বোঝার উপায় নেই, ভিতরে কী চলছে। খাড়া পাহাড়ের মতো সিঁড়ির সরু ধাপ পেরিয়ে উঠতেই অন্য সাম্রাজ্য। রংবেরঙের জরি নিয়ে হাতে নকশা বুনে চলেছেন কয়েক জন কারিগর। অন্য ঘরে চলছে মেশিনে নাগরাই জুতোর নকশা তৈরি। মাথা তোলার ফুরসতটুকুও নেই তখন।

Advertisement

মহাজাতি সদনের পিছনে মার্কাস স্কোয়ার সংলগ্ন এই এলাকার কয়েক ঘরে এ ভাবেই চলছে রমজান মাসের শেষে খুশির ইদের প্রস্তুতি। হাতে মাত্র দিন সাতেক। এরই মধ্যে গুটিয়ে নিতে হবে সব কাজ। হাল্কা গোলাপি নেটের উপরে তখন ‘অ্যান্টিক জরি’র সূক্ষ্ম কাজ করে চলছেন কারিগর। আঠারো কলির সেই লেহেঙ্গার জন্য তাঁদের বরাদ্দ বারো হাজার টাকা। শহরের কোনও নামী বুটিক হয়ে যখন
কোনও তরুণীর গায়ে উঠবে, তখন দাম ছুঁয়ে যাবে হাজার পঁচিশেকে। পাশের ঘরে তখন জরির সূক্ষ্ম কাজের ব্লাউজ আর জরির টুপি করছেন কারিগর। লাল-নীল-সোনালি-সাদা সে সব জরি আসে মুম্বই, গুজরাত, জাপান থেকে। ৫০-২৫০ গ্রাম লেচির সেই জরির হরেক দাম। ১৫-৮০০ টাকা পর্যন্ত।

পাশের ঘর থেকে তখন একটানা ভেসে আসছে ঘড়ঘড় শব্দ। উঁকি মারতেই দেখা গেল, নির্দিষ্ট মাপে কাটা রেক্সিনের উপরে মেশিন দিয়ে কারিগর বুনে চলেছেন জরির নকশা। সেই নকশা করা নাগরার পাইকারি দাম দুশো টাকা। কিন্তু বড় কোম্পানির ছাপ লাগতেই তারই দাম দাঁড়ায় প্রায় পাঁচশো।

Advertisement

নাগরার নকশা।

সেই পুরনো কাসুন্দি। শিল্পীর দাম নেই। সে কারণেই এই শহরের হোক বা বারাসত, আরামবাগ, রানিহাটির ঘরে ঘরে, জরি শিল্প থেকে মুখ ঘোরাচ্ছেন অনেকে। এ শহরের এমনই এক জরি শিল্পী মহম্মদ আসরাফ। সামান্য মজুরি পাওয়া এই শিল্পী এখন ফলমান্ডিতে ভ্যান টানেন। আর এক কারিগর মহম্মদ রিয়াজের কথায়, “জরি শিল্পীদের এক ছাদের নীচে এনে কারখানা তৈরির কথা শুনেছিলাম। কোথায় গেল সেই প্রতিশ্রুতি? অথচ বহু কারিগর কাজ করেও মহাজনেদের থেকে টাকা না পেয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছেন।”

রোজার ক্লান্তি ঢাকতে চোখে সুর্মা টানতে টানতে বলে চলেন রিয়াজ, “রমজান মাসে বাধ্যতামূলক সাজ সুর্মা। তাই বোধহয় আজও নাগালের মধ্যে এর দাম।” যদিও হিন্দু পরিবারেও এর ব্যবহার রয়েছে। কারণ “সুর্মার গুণাগুণ অনেক। রাতে শোওয়ার আগে সুর্মা লাগিয়ে সকালে চোখ ধুয়ে নিলেই টের পাওয়া যাবে পার্থক্য। চোখের সংক্রমণ দূর করতে, ক্লান্তি মেটাতে আর চোখের পাতার বৃদ্ধিতে নিয়মিত ভাল মানের সুর্মার ব্যবহার অনবদ্য।”— বলছিলেন জাকারিয়া স্ট্রিটের ১৩০ বছরের দোকানের এক কর্ণধার জামালউদ্দিন। তাই আধুনিকতাও টলিয়ে দিতে পারেনি সুর্মার বাজার।

পথের দু’ধারে থরে থরে জরির কাপড়, শেরওয়ানি, আর টুপির ফাঁক গলে সাজানো আতর, সুর্মা আর তার সুসজ্জিত দানি। নাখোদা মসজিদ এলাকার প্রাচীন এই জনপদ থেকে কতটা দূরত্ব পশ্চিম এশিয়ার মাউন্ট সিনাইয়ের? কোরানে কো-এ-তুর নামে পরিচিত এই পবিত্র পাহাড়ের পাথরের গুঁড়োই তো হল এই সুর্মা। সেই পাথরের টুকরো চলে আসে দিল্লি। তার সঙ্গে কর্পূর এবং আরও তিন-চার রকম জড়িবুটি মিশিয়ে তৈরি হয় সুর্মা। বয়সের ভেদে হয় সুর্মার নাম— মামেরা, গুলাব, বড়েয়ানি। এই মিশ্রণেই লুকিয়ে রয়েছে বিভিন্ন সুর্মা প্রস্তুতকারক সংস্থার ‘গোপন চাবি’। —বলছিলেন জাকারিয়া স্ট্রিটের ১৯৪ বছরের পুরনো দোকান খুদা বক্স নবী বক্সের নবম বংশধর নেওয়াজউদ্দিন আল্লা বক্স।

তবে আজও বিশ্বাসী মন বলে যায়, সুর্মার আসল গোপনীয়তা আগলে রেখেছে কো-এ-তুর।

ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন