হাসপাতালে আগুন

বেঁচে গেলাম শুধু ডাক্তারবাবুদের দয়ায়

স্টোভের আগুনে পুড়ে মরতে মরতে কোনও মতে বেঁচে গিয়েছিলাম। আর আজ হাসপাতালের আগুন থেকেও বেঁচে গেলাম। না, বরাতজোরে নয়। বেঁচেছি শুধু এই হাসপাতালের ডাক্তারবাবুদের দয়ায়। গোড়া থেকে ভাবতে বসলে সবটাই কেমন যেন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে।

Advertisement

শবনম খান

শেষ আপডেট: ২২ নভেম্বর ২০১৬ ০১:৪৬
Share:

সোমবার, এসএসকেএম হাসপাতালে। ছবি: রণজিৎ নন্দী

স্টোভের আগুনে পুড়ে মরতে মরতে কোনও মতে বেঁচে গিয়েছিলাম। আর আজ হাসপাতালের আগুন থেকেও বেঁচে গেলাম। না, বরাতজোরে নয়। বেঁচেছি শুধু এই হাসপাতালের ডাক্তারবাবুদের দয়ায়। গোড়া থেকে ভাবতে বসলে সবটাই কেমন যেন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে।

Advertisement

রান্না করতে করতে স্টোভ ফেটে আমার গলা থেকে পা পর্যন্ত অনেকটা অংশ পুড়ে গিয়েছিল। এসএসকেএম হাসপাতালের ডাক্তারবাবুরাই আমাকে প্রাণে বাঁচিয়েছেন। পুড়ে চামড়া গলে যাওয়া আমার পায়ে স্কিন গ্রাফটিং হয়েছে সপ্তাহ খানেক আগে। ঠিক ছিল আরও দু’সপ্তাহ পরে গলাতেও স্কিন গ্রাফটিং হবে। সেই মতোই মানসিক প্রস্তুতি চলছিল। ডাক্তারবাবুরা বলেছিলেন, আজ অর্থাৎ সোমবার থেকে আমাকে একটু –একটু করে হাঁটানো শুরু করা হবে। সকালে অপেক্ষা করছিলাম, কখন হাঁটব।

হঠাৎই শুনি চারপাশ থেকে চিৎকারের আওয়াজ। ধুপধাপ শব্দ। কী হয়েছে বোঝার আগেই আশপাশে অনেকে বলতে শুরু করলেন, ‘বাঁচতে হলে পালাও!’। কিন্তু আমি পালাব কী করে? পায়ের অস্ত্রোপচারের পরে আমার তো সবে আজ থেকেই হাঁটা শুরু হওয়ার কথা। সবাইকে দৌড়তে দেখছি আর বলছি, আমাকে খাট থেকে একটু নামিয়ে দেবেন? কেউ আমার কথা শুনছেন না। শুনবেন কী করে? সকলেই তো নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। এর পরে হঠাৎই দেখি ধোঁয়া ঢুকছে ঘরে। সঙ্গে পোড়া-পোড়া গন্ধ। বুঝলাম হাসপাতালে আগুন লেগেছে। চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। আমার বাবা-মা, ছোট বোনটার মুখ ভেসে উঠল। আমার বাড়ি গয়ায়। এখানে নিউ মার্কেটের কাছে থাকি। মনে হচ্ছিল কোনও দিন আর বাড়ি ফিরতে পারব না। ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলাম।

Advertisement

এ রকম একটা সময়েই কেউ আমার হাত ধরলেন। তাকিয়ে দেখি একজন সিনিয়র ডাক্তারবাবু। তাঁর নাম জানি না। কিন্তু ওয়ার্ডে অনেক বার দেখেছি। উনি আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বললেন, ‘‘আস্তে আস্তে নামতে হবে তোমাকে। মনে জোর আনো। ঠিক পারবে তুমি।’’ উনি আমাকে ধরে ধরে সিঁড়ির কাছে নিয়ে এসে রেলিংটা ধরিয়ে দিলেন। চারপাশে তখন অনেকেই দৌড়ে নীচে নামছেন। আমি দু’এক পা নেমেই থমকে গেলাম। খাটের নীচেই তো আমার ব্যাগটা ছিল। সেখানে আমার জমানো কিছু টাকা, আমার চিকিৎসার সব কাগজপত্র, ওষুধ, জামাকাপড়, এমন কী আমার মায়ের ছবিটাও রয়েছে। হাসপাতালে থাকাকালীন ওই ব্যাগটাই আমার সংসার। পিছন ফিরে চেঁচিয়ে বললাম, ‘‘ডাক্তারবাবু আমার ব্যাগটা রয়েছে ঘরে।’’ উনি চেঁচিয়ে উঠে আমাকে বকলেন, ‘আগে নিজে বাঁচো, তার পরে ব্যাগের চিন্তা।’ আমি কিচ্ছু বলিনি। আমার দু’চোখ বেয়ে জল পড়ছিল। আস্তে আস্তে নামছিলাম। হঠাৎই দেখি ডাক্তারবাবু আমার পাশে। ওঁর কাঁধে আমার ব্যাগটা। উনি এক হাতে আমার হাতটা শক্ত করে ধরে নীচে নামিয়ে আনলেন। ব্যাগটা আমার পাশে রেখে বললেন, ‘এই রইল তোমার সম্পত্তি!’ বলেই আবার দৌড়লেন উপরে। বোধহয় আমার মতো অন্য কাউকে বাঁচানোর জন্য।

সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারবাবুদের নিয়ে কত কথা শুনি! হাসপাতালে ভর্তি থাকাকালীন গত কয়েক সপ্তাহে আমারও অনেকের উপরে মাঝেমধ্যেই রাগ হয়েছে। মনে হয়েছে, ওঁরা ঠিক যত্ন নিচ্ছেন না। কিন্তু আজ সব কিছু কী ভাবে যেন ধুয়েমুছে গেল। আমি যে প্রাণে বেঁচেছি, এই যে নিজের কথা এ ভাবে বলতে পারছি, তা তো এক ডাক্তারবাবুর জন্যই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন