হাসপাতালে দেবব্রত কুলাই। মঙ্গলবার। — নিজস্ব চিত্র।
সকাল সাড়ে ৯টা। ব্যস্ত রাস্তায় যাত্রী তুলতে দাঁড়িয়েছে বাস। পিছনে থমকে দাঁড়িয়ে একটা সাদা ইনোভা গাড়ি। তার পিছনের আসনে যাত্রী মাত্র এক জন। পাশে রাখা তিনটি ব্যাগ। আচমকাই সেই গাড়ির সামনে পথ আটকে দাঁড়াল একটি মোটরবাইক। হেলমেটে মুখ-ঢাকা তিন আরোহী নেমেই রিভলভার হাতে ঘিরে ধরল গাড়িটিকে। এর পরেই পরপর তিনটি গুলি। প্রথমটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পিছনের দরজা ফুটো করে বেরিয়ে গেল। বাকি দু’টির একটি বিঁধল চালকের কোমরের নীচে, অন্যটি বেরিয়ে গেল যাত্রীর বাঁ হাত ফুঁড়ে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিমেষে গাড়িতে রাখা টাকাভর্তি ব্যাগ নিয়ে ফের বাইকে চেপেই চম্পট দিল দুষ্কৃতীরা। একেবারে সিনেমার মতো।
মঙ্গলবার ভরা অফিসটাইমে আন্দুল রোডে পোদরা হালদারপাড়ার এই দুঃসাহসিক ছিনতাইয়ের ঘটনায় ফের প্রশ্নের মুখে এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও পুলিশি নজরদারি। মাস সাতেক আগে ওই জায়গাতেই এক মহিলার হার ছিনিয়ে নিয়েছিল মোটরবাইকে আসা তিন দুষ্কৃতী। তার পরেও যে পুলিশের হুঁশ ফেরেনি, এ দিনের ঘটনাই তার প্রমাণ।
পুলিশ জানায়, আন্দুল রোডের নিমতলায় এক বেসরকারি বণ্টন সংস্থার অফিস থেকে ওই ইনোভা গাড়িটিতে ১০ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা নিয়ে ব্যাঙ্কে জমা দিতে যাচ্ছিলেন সংস্থারই দুই কর্মী। গাড়িটি চালাচ্ছিলেন মহম্মদ ইসরাফিল। পিছনে ছিলেন সংস্থার কোষাধ্যক্ষ দেবব্রত কুলাই। তাঁদের গন্তব্য ছিল লক্ষ্মীনারায়ণতলায় ব্যাঙ্ক অব বরোদার একটি শাখা। সংস্থা সূত্রে জানা গিয়েছে, সোম থেকে শুক্র প্রতিদিন অফিসের ওই গাড়িতে এ ভাবেই টাকা নিয়ে ওই ব্যাঙ্কেই জমা দিতে যেতেন ওই দুই কর্মী।
পুলিশ জানায়, যানজট থাকায় আস্তে গাড়ি চালাচ্ছিলেন ইসরাফিল। হালদারপাড়ার কাছে আচমকাই পথ আটকায় মোটরবাইক। মুখ-ঢাকা দুষ্কৃতীরা গাড়িটিকে ঘিরে ধরার পরে এক জন চালককে কাচ নামাতে বলে। ইসরাফিল ইতস্তত করতেই গুলি চালায় ওই দুষ্কৃতী। সেটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ায় ফের গুলি। এ বার সেটি ইসরাফিলের শরীরের পিছন দিকে লাগে। ইতিমধ্যে পিছনে বসে থাকা দেবব্রতর দিকে এগিয়ে যায় আর এক দুষ্কৃতী। রিভলভারের বাট দিয়ে গাড়ির কাচ ভেঙে দেবব্রতর পাশে রাখা ব্যাগগুলি দিতে বলে সে। তিনি রাজি না হলে ব্যাগগুলি কেড়ে নিতে চেষ্টা করে দুষ্কৃতীরা। শুরু হয় ধস্তাধস্তি। শেষ পর্যন্ত দুষ্কৃতীদের কাছে হার মানেন দেবব্রত। তার মধ্যেই দুষ্কৃতীরা ফের গুলি করলে সেটি তাঁর বাঁ হাতে লাগে। ব্যস্ত সময়ে আশপাশে গাড়িতে, রাস্তায় তখন প্রচুর লোক। সকলের চোখের সামনে দিয়েই ব্যাগ নিয়ে দ্বিতীয় হুগলি সেতুর দিকে পালায় দুষ্কৃতীরা। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে দেবব্রত ও ইসরাফিলকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করেন স্থানীয়েরাই।
এ দিন হাসপাতালে শুয়ে দেবব্রত বলেন, ‘‘ড্রাইভারকে গুলি করার পরেও টাকার ব্যাগ আগলাতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আমার হাতে গুলি লাগার পরে আর কিছু করতে পারিনি।’’
ওই বেসরকারি সংস্থার কর্ণধার পিয়াল ভদ্র বলেন, ‘এর পরে কী ভাবে ব্যবসা চালাব, ভেবে পাচ্ছি না। সকালবেলা ব্যস্ত রাস্তায় এমন ঘটলে এর পরে তো অফিসেও হামলা হবে!’’
প্রকাশ্য দিবালোকে চোখের সামনে এমন ঘটনা দেখেও কেউ এগিয়ে এলেন না কেন? প্রত্যক্ষদর্শীদের এক জন জানান, দুষ্কৃতীদের হাতে রিভলভার থাকায় কেউ এগোতে সাহস পাননি। প্রশ্ন উঠেছে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও। দিনের ব্যস্ত সময়ে এত বড় ঘটনা ঘটল অথচ পুলিশ কিছু টেরই পেল না কেন? নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলে এর জন্য পুলিশি নিষ্ক্রিয়তাকে দায়ী করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
খবর পেয়ে এ দিন ঘটনাস্থলে ছুটে যান জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গ্রামীণ) ইন্দ্র চক্রবর্তী। পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ নস্যাত্ করে তিনি বলেন, “একটা ঘটনা দিয়ে নিষ্ক্রিয়তা প্রমাণ হয় না। দুষ্কৃতীদের ধরার চেষ্টা চলছে। তারা স্থানীয় না বহিরাগত খতিয়ে দেখা হচ্ছে।” প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান, দুষ্কৃতীদের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য ছিল। তা না হলে এ ভাবে অপারেশন চালানো সম্ভব হতো না।