রেলিং থেকে পথ, জরাজীর্ণ সবই

রেলিংয়ে রঙের পোঁচ, রাস্তায় পিচের প্রলেপ। কিন্তু ক্ষয়িষ্ণু কাঠামোয় পড়ে না নজর। এ ভাবেই এক বিপর্যয়ের পরে আসে আর এক বিপর্যয়। কোন ‘সেতুশ্রী’র কী হাল, খোঁজ নিলেন অনুপ চট্টোপাধ্যায়, ঋজু বসু ও আর্যভট্ট খান।

Advertisement

অনুপ চট্টোপাধ্যায় ও ঋজু বসু ও আর্যভট্ট খান

শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০১:২৯
Share:

টালা সেতুর রেলিংয়ের দৈন্য দশা। সারানো হয়েছে অরবিন্দ সেতুর নীচের অংশ। ফাটল ধরেছে চিং়ড়িঘাটা উড়ালপুলের কংক্রিটের স্ল্যাবে ভাঙাচোরা অম্বেডকর সেতু। বৃহস্পতিবার। নিজস্ব চিত্র

শিয়ালদহ উড়ালপুল: আশির দশকে তৈরি হওয়া এই উড়ালপুল শহরের ব্যস্ততম উড়ালপুলগুলির অন্যতম। নীচে প্রায় পাঁচ হাজার ব্যবসায়ীর রোজকার কারবার। পোস্তা সেতুর বিপর্যয়ের পরে এই উড়ালপুলের স্বাস্থ্য পরীক্ষার ভার দেওয়া হয়েছিল রাইটসকে। নগরোন্নয়ন দফতর সূত্রের খবর, আজ পর্যন্ত সেই কাজ হয়নি। কারণ জানতে চাইলে জবাব মিলছে, সেতুর নীচে দোকান এবং হকার ভর্তি। সে কারণে সেতুর স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য মেশিন ঢোকানোর রাস্তাটুকুও পাওয়ার উপায় নেই। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, উপর থেকে অনেক জায়গায় জল পড়ছে। ব্যবসায়ীরা জানালেন, ট্রামলাইনের কাজ চলার জন্য এই অবস্থা। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয়, দু’টি স্ল্যাবের মধ্যে খাঁজ তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ এক দিক বেশি বসে যাওয়ায় আতঙ্ক ছিলই। মাঝেরহাটের পরে তা আরও বেড়েছে।

Advertisement

টালা সেতু: ‘অপুর সংসার’ তৈরির সময়ে এই সেতুতেই যুবক অপু, নবাগত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে শুটিং করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। তখনও সেতুর দু’ধারে রেলিংয়ের বদলে টিনের আড়াল থাকত। গত শতকের ষাটের দশকে এক বার সেতু থেকে দোতলা বাস পড়ে দুর্ঘটনা ঘটেছিল। তার পরে ধীরে ধীরে সেতুর চেহারা পাল্টেছে। বছর দুই আগে নীল-সাদা রং পড়লেও সেতুর মাঝের রাস্তা বা ‘জাহাজের ডেক’-এ বিক্ষিপ্ত ক্ষতচিহ্ন ভরপুর।

তথ্য বলছে, মাঝেরহাট এবং টালা— দুই সেতুই তৈরি হয়েছিল ষাটের দশকে। প্রযুক্তিও ছিল এক। এখন সেই সেতুর ফুটপাতের ভিতরকার ফাঁক দিয়ে জায়গায় জায়গায় বেরিয়ে আসছে সিইএসসি-র কেব্‌ল। নীচে খালধারের ঝুপড়ির ধারে সেতুর গায়ে ভাঙাচোরা দাগ। উপরের রাস্তাও ভাঙাচোরা। ঝুপড়িবাসীদের দাবি, ইট দিয়ে রাস্তা চাপা দিয়ে না-রাখলে তাতে পা ঢুকে অনেকেই আহত হতে পারেন। সেতুর কিছুটা অংশ রেললাইন, খাল ও জনবসতির উপর দিয়ে গিয়েছে। স্থানীয় প্রশাসনের এক কর্তার কথায়, ‘‘বছর দু’য়েক আগে সেতুটির সার্বিক মেরামতির কথা হয়েছিল। কিন্তু সব কাজ করা যায়নি।’’ সেতুর নীচ দিয়ে গিয়েছে কলকাতার পাঁচটি এলাকার গুরুত্বপূর্ণ জলের লাইন। পূর্ত দফতর সূত্রের খবর, মেরামতি করতে গেলে জলের লাইনের ক্ষতি না-করেই করতে হবে।

Advertisement

টালা সেতুর রেলিংয়ের দৈন্য দশা।সারানো হয়েছে অরবিন্দ সেতুর নীচের অংশ।ফাটল ধরেছে চিংড়িঘাটা উড়ালপুলের কংক্রিটের স্ল্যাবে।ভাঙাচোরা অম্বেডকর সেতু। বৃহস্পতিবার। নিজস্ব চিত্র

অরবিন্দ সেতু: খন্না মোড় থেকে উল্টোডাঙা পর্যন্ত বিস্তৃত এই সেতু দিয়ে প্রতিদিন সল্টলেক এবং ভিআইপি রোডের দিকে অসংখ্যা যানবাহন চলাচল করে। প্রায় ৪০০ মিটার দীর্ঘ সেতুটি অর্ধশতাব্দীর পুরনো বলে পুরসভা সূত্রের খবর। এর মাঝখানের রাস্তায় ধস নেমেছিল গত বছর। তার পরেই আতঙ্ক বাড়ে স্থানীয় মহলে। পুর ও নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের পরিদর্শনের পরে সেতুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করে কেএমডিএ। সংস্থার এক ইঞ্জিনিয়ার জানান, গত বছরের সেই ক্ষতে প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। সারানো হয়েছে সেতুর নীচে ক্ষয়ে যাওয়া অংশও। তবে পুরসভার ইঞ্জিনিয়ারেরাই মানছেন, অবিলম্বে অরবিন্দ সেতুর সার্বিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা প্রয়োজন।

চিংড়িঘাটা উড়ালপুল: ইএম বাইপাস থেকে চিংড়িঘাটা মোড় হয়ে নিউ টাউন বা সল্টলেকে ঢুকতে গেলে এই উড়ালপুলটিই একমাত্র মাধ্যম। ২০০৪ সালে এর উদ্বোধন করেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। বাস থেকে শুরু করে ছোট-বড় গাড়ি— সবই চলে উড়ালপুলের উপর দিয়ে। কিন্তু অভিযোগ, অপেক্ষাকৃত নতুন হলেও এর অবস্থা মোটেই সন্তোষজনক নয়। প্রায় গোটা রাস্তাই এবড়োখেবড়ো। একাধিক বাঁক থাকায় যে কোনও মুহূর্তে দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। বৃহস্পতিবার গিয়ে দেখা গেল, উড়ালপুলের সল্টলেকের দিকে যেখানে দু’টি গার্ডার জোড়া লাগানো, তার ঠিক পাশেই কংক্রিটের স্ল্যাবে ফাটল ধরেছে। এমন ফাটল রয়েছে আরও একাধিক জায়গায়।

উড়ালপুলের স্তম্ভের গা-ঘেঁষে গড়ে উঠেছে বসতি। সেখানে অবাধে চলছে আগুন জ্বালিয়ে রান্না। বাসিন্দাদের আরও অভিযোগ, উড়ালপুলে বাস বা অন্য ভারী গাড়ি ওঠা নিষেধ হলেও তা কেউই মানেন না। কয়েক বার কেএমডিএ-র কর্মীরা এসে কিছু কিছু জায়গায় তাপ্পি দিয়ে গিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু এলাকাবাসীর দাবি, দরকার স্থায়ী সমাধান। সংস্থার আধিকারিকেরাও মানছেন, মাঝেমধ্যে মেরামতি হলেও চিংড়িঘাটা উড়ালপুলের পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্য পরীক্ষা আশু প্রয়োজন।

অম্বেডকর সেতু: সেতুর কংক্রিটের রেলিং ভেদ করে বেরিয়েছে গাছ। তার শিকড় ক্রমশ ছড়াচ্ছে গভীরে। বাসিন্দাদের অভিযোগ, যত দিন যাচ্ছে, ততই বাড়ছে গাছের সংখ্যা। মাঝেমধ্যে ডাল ছাঁটা হয় ঠিকই, কিন্তু গাছ যাতে না গজায় তার স্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। পাশাপাশি, এই সেতুর অন্যতম প্রধান সমস্যা নিকাশি। জমে থাকা জল বেরোনোর জায়গা নেই। ফলে বেশ কিছু জায়গায় কংক্রিটের ফাটল দিয়েই সেই জল চুঁইয়ে পড়ছে। কোথাও কোথাও বেরিয়ে পড়েছে সেতুর ইট।

রেলিংয়ের লাগোয়া কিছু জায়গায় একটু বড় টব করা আছে। সেখানে গাছ-মাটির বদলে জমে আছে জল। অভিযোগ, সৌন্দর্যায়নের জন্য ওই টব বসানো হলেও সেখানে কোনও দিনই গাছ লাগানো হয়নি। বরং জমা জলে বংশবিস্তার করছে ডেঙ্গির জীবাণুবাহী মশা। আশির দশকে বাইপাস তৈরির সময়েই অম্বেডকর সেতু তৈরি হয়। ক্রমে বাইপাসের উপরে গাড়ির চাপ বেড়েছে। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সেতুর ব্যবস্ততাও। কিন্তু প্রয়োজনীয় মেরামতিতে কোনও পক্ষেরই নজরদারি সে ভাবে নেই।

(আগামী কালের ‘সেতুশ্রী’রা: বিজন সেতু, ঢাকুরিয়া সেতু ও গড়িয়াহাট সেতু)

(শহরের প্রতি মুহূর্তের সেরা বাংলা খবর জানতে পড়ুন আমাদের কলকাতা বিভাগ।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন