‘আমরা সকলে এক গাড়িতে যাব!’ বেঙ্গল ক্লাব থেকে বেরোনোর মুখে জিদ্দি বাচ্চার মতো জানিয়ে দিল পাওলি।
সাড়ে বারোটা নাগাদ তুমুল বৃষ্টি পেরিয়ে পৌঁছেছি পার্ক স্ট্রিট পাড়ায়। নামেই ষষ্ঠী। ঝমঝমে ছাই রঙে ভেসে যাওয়া দুপুরটাকে জুলাই বলে ভুল হচ্ছে বারবার। বাইরে দু’একখানা বই-বাহিক বিপণি আর অগুণতি বার-দুয়ারের হাতছানি। তাও ‘পার্লে আনন্দবাজার পত্রিকা শারদঅর্ঘ্য ১৪২১’-এর বিচারকসুলভ গাম্ভীর্য বজায় রাখতে আমরা জনা পনেরো মানুষ লাঞ্চ সেরে পুজো দেখতে বেরোনোর অপেক্ষায়।
প্রায় বেরিয়েই পড়ছিলাম কয়েকজন, এমন সময়ে হন্তদন্ত হয়ে এসে রাশ টানলেন এই কর্মকাণ্ডের এক উদ্যোক্তা। মিনিট দশেকের মধ্যে উত্তর, দক্ষিণ এবং হাওড়ায় ভাগ হয়ে গেলাম আমরা এক ঝাঁক জাজ। মনে মনে ‘দক্ষিণ দক্ষিণ’ জপছিলাম, শেষমেশ দৈববলে দক্ষিণের বারান্দায় আমার নাম টাঙানো দেখে গ্রুপ ফোটোর চেয়ার থেকে প্রায় লাফিয়েই উঠলাম। বিমলদা (ভাস্কর বিমল কুণ্ডু), শিবু (পরিচালক শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়), পাওলি (ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন), গার্গী (ওই) এবং আমি (এই প্রবন্ধের লেখক) শেষমেশ দক্ষিণের পাঁচখানা পুজো দেখার বরাত পেলাম। প্রত্যেক বিচারকের জন্যে একটি করে ফাইভ সিটার বিরাট গাড়ি বরাদ্দ, কিন্তু সেই নিয়ম মানলে ঠাকুর দেখার মজাটাই মাটি। তাই বেরোনোর মুখেই পাওলির এই ফতোয়া। যদিও বিমলদা এই গাড়িটা মিস করলেন, কারণ আমরা চারজন পিছনে বসলেও, গাড়ি পিছু এক জন ট্যুর গাইড আবশ্যিক। অবিশ্যি বিমলদা’র সঙ্গে তাঁর দুই তরুণ ভাগ্নে থাকায় একাকীত্বের হাত থেকে ষষ্ঠীর দুপুরটা রেহাই পেলেন এবং পরের গাড়ি ধরলেন। কথা হচ্ছে, একটা লিমুজিন থাকলে এত ঝামেলাই হত না।
এমনিতে যেচে ঠাকুর দেখতে বেরোনোটা সেই যৌবন থেকেই আমার ধাতে নেই। বাড়িতে বসে পাড়ার পুজোয় ‘নিভৃত প্রাণের দেবতা’ থেকে ‘চিকনি চামেলি’ শুনে বুঝতে পারি, তিথি পাল্টাচ্ছে। কিন্তু প্রতি বছরই বিচারের ছুতোয় বেশ কিছু পুজো দেখা হয়েই যায় এবং ভিড়ের মধ্যেও বেশ নিভৃতেই হয় ব্যাপারটা। এ বারেও তেমনই হল। আমাদের দুটো গাড়ির পেছনে আরও গোটা পাঁচেক সাদা গাড়ি, সামনে তিনখানা বাইক আর মূর্তিমান পুলিশ কনভয়। সব মিলিয়ে নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ মনে না-করার কোনও রাস্তা নেই।
তবে কিনা, ফি-বছর পুজো দেখার অছিলায় যেটা জমে ওঠে, সেটা হল এই বিচারকদের মধ্যেকার আড্ডা। বিশেষত যদি কাছাকাছি বয়স হয়। এমনিতে নানা জমায়েতে দেখা হলেও গুছিয়ে গপ্পো তো হয়ে ওঠে না, সেই দিক থেকে দেখতে গেলে এ ধরনের বিচারপর্বগুলো বেশ একটা আড্ডার পিকনিক হয়ে ওঠে। এ বারেও তাই হল। গাড়ি পার্ক স্ট্রিট ছাড়িয়ে আলিপুর ধরতে না ধরতে হাসি আর হইচই চালু। এর মধ্যে বলে রাখি, গার্গী আর পাওলি এক্কেবারে এক রকম দেখতে লালপেড়ে সাদা শাড়ি পরা এবং গোড়া থেকে সেই নিয়ে বিস্তর খেদ প্রকাশ করে চলেছে। এই আক্ষেপই অবিশ্যি সন্ধের পর উচ্ছ্বাসে বদলে গিয়েছিল, সে-কথা ক্রমশ প্রকাশ্য।
প্রথম পুজো ঠাকুরপুকুরের স্টেট ব্যাঙ্ক পার্ক সর্বজনীন দুর্গোৎসব। ষষ্ঠীর বিকেল বৃষ্টিতে বেশ মার খেয়েছে, অন্তত রাস্তাঘাটের চেহারা তাই বলছে। লোকজন বেশ কম। যদিও পুজোমণ্ডপে নামামাত্র শুকনো মেজাজ রমরম করে উঠল। একটাই গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি মণ্ডপ আর প্রতিমা, রাজস্থানের মোটিফ ছড়িয়ে আছে এ দিক ও দিক।
বলে রাখি, আশ্চর্য ভাবে আমরা পাঁচ বিচারকই থিমের বাড়াবাড়িটা মোটে বরদাস্ত করতে পারি না। চারপাশে এখন যে একটা বুঝিয়ে-দেব গোছের ভাবনার উদয় হয়েছে, সেটা হজম হয় না। নতুন নতুন মাথা-খুঁড়ে-আবিষ্কৃত জটিল থিম, ষষ্ঠীতে বোঝা শুরু করলে ভাইফোঁটায় শেষ হবে। কৈশোরের পুজোয় যে ম’ ম’ করতে থাকা পুজোর গন্ধ, থিমের জাঁকজমকে সেইটাই আর খুঁজে পাই না।
যে রকম দেরিতে শুরু করেছি, সেই রাতের আগে ছাড়া পাব না ভেবে সকলেই মুষড়ে পড়েছিলাম। কিন্তু ভয়ের থেকেও শক্তিশালী কনভয়। তাই ঝপাঝপ পরের তিনটে পুজোয় টহল সারা হয়ে গেল। হরিদেবপুরের অজেয় সংহতি থেকে সন্তোষপুরের লেকপল্লি হয়ে যোধপুর পার্ক পঁচানব্বই পল্লি। কোথাও মাটির প্রদীপ, কোথাও প্লাস্টিকের কাপ, আবার কোথাও টায়ার আর জাল দিয়ে তৈরি নৌকার আদল।
পাঁচ জাজের নম্বর কাছাকাছিই ঘোরাফেরা করছে। পথ চলতে গার্গী আর পাওলি জমাটি গল্পগাছা শোনাচ্ছে, আমি আর শিবু দেদার উপভোগ করছি। শ্রোতা হিসেবে পুরুষ চিরকালই ভাল। বিমলদা’র গাড়িতে অবশ্য সকলেই পুরুষ, কী হচ্ছে কে জানে।
ক্লান্ত হইনি কেউই, কিন্তু ঠিক মনের মতো পুজো পাইনি এখনও। হতাশ হয়েই ফিরতে হবে কি না ভাবছি, এমন সময়ে গাড়ি ঢুকল ফাইনাল ডেস্টিনেশন হিন্দুস্থান পার্কের মণ্ডপ চত্বরে। এতক্ষণে পুজোর মতো একখানা পুজো!
কোরা সাদায় আর লালে ভাগ হয়ে গিয়েছে গোটা মণ্ডপের প্যালেট, হলুদ টুনির ইতিউতি উঁকিতে সেই সাজ ঝলমল। কাপড়ের জবার মালা, চাঁদোয়া থেকে লাল সুতোয় বাঁধা শাখা-পলার অসংখ্য জোড়া, সঙ্গে দেওয়ালে কাঁচা সিঁদুরের প্রলেপ। কোনও ব্যাখ্যা, কোনও প্রমাণের চেষ্টা নেই। সোজা বুকে এসে ধাক্কা মারল পুজোর গন্ধ। আর কোরা সাদায় লালে নিজেদের সাজে খুশি হয়ে উঠল আমাদের দুই রূপসী বন্ধু।
মণ্ডপ ছেড়ে বেরোনোর মুখে ঢাকের সারি সাজানো। হাতে তুলে নিলাম কাঠি, কোমরে আঁচল গুঁজল মেয়েরাও। ছোটবেলায় বাড়ির পুজোয় খুব বাজাতাম, সেদিন মাত্র পাঁচ মিনিটে সেই ছোটবেলা ফিরিয়ে দিল হিন্দুস্থান পার্ক। প্রাণ খুলে নাচল পাওলি আর গার্গী, শিবুও নেমে পড়ল হইহই করে। ঘেমেনেয়ে ফুচকা, ঝালমুড়ি আর আইসক্রিম খেয়ে আমরা যখন বেরিয়ে আসছি, তখন মনখারাপ।
খাতায় কলমে শেষ পুজোটাই যে প্রথম স্থান পেয়েছে, সেটা বুঝতে তখন আমাদের কারও বাকি নেই। কিন্তু বৃষ্টি দিয়ে শুরু এমন একটা মেঘলা ষষ্ঠীতে আমাদের সারাদিনের বেরানো-আড্ডা-খুনসুটিটাই সবচেয়ে বেশি নম্বর পেল শেষমেষ। ওটাই তো আসল পুজো, ওটাই তো বেঁচে থাকার থিম!