বটতলা রেললাইনের কাছে নিজের দোকানে নুরুল ইসলাম। বৃহস্পতিবার, গার্ডেনরিচের ফুটপাতে। নিজস্ব চিত্র
‘‘আমি তো আজকের নই। প্রায় ১৫-১৬ বছরের দোকান আমার এখানে।’’— কথাগুলো বলছিলেন নুরুল ইসলাম। গার্ডেনরিচের বটতলা রেললাইনের কাছে তাঁর ছোট্ট দোকান। পাশেই পূর্বাশা পুর প্রাথমিক বিদ্যালয়। উল্টো দিকে পুরসভার প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। দোকানের একচিলতে জায়গায় চলে নিত্যদিনের বিকিকিনি। কিন্তু তাতেই বৃহস্পতিবার ভাটা পড়েছে। কারণ, রাস্তাঘাট ফাঁকা। যে ক’জন হাতে গোনা লোকজন রয়েছেন, তাঁরাও ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়চ্ছেন নিজের নিজের গন্তব্যের দিকে। সিগারেটের দোকানে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করতে যেন নারাজ তাঁরা।
নুরুল বলছিলেন, ‘‘এখানে বসেই অনেকগুলো ভোট, ভোটের ফল বেরোনোর দিন দেখলাম। কিন্তু এ বারের মতো কখনও দেখিনি। এত ফাঁকা কোনও বার থাকেনি। চা-খরচের টাকা পর্যন্ত উঠছে না!’’ ষাটোর্ধ্ব নুরুল ঠিকই বলছিলেন। গার্ডেনরিচ, মেটিয়াবুরুজ এ দিন অদ্ভুত ভাবে ‘থমথমে’। রাস্তার পাশের যে সব দোকানে টিভি রয়েছে, সেখানে লোকজন ভিড় করেছেন বটে। কিন্তু তাঁদের মুখে কোনও কথা নেই। চুপচাপ ভোটের ফলে দৃষ্টি নিবদ্ধ।
গার্ডেনরিচ রোডের উপরে সে রকমই একটি দোকানে টিভি চলছিল। আটা বিক্রির ওই দোকানে ক্রেতার দেখা নেই। টিভির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন কয়েক জন। তখনও পর্যন্ত ফলাফলের যা ‘ট্রেন্ড’, তাতে দেখা যাচ্ছিল তৃণমূল ২৫টি আসনে এগিয়ে রয়েছে, বিজেপি ১৬ ও কংগ্রেস ১টিতে। ওখানেই দাঁড়ানো জনৈক আমিরুদ্দিন তখনও যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না ওই ‘ট্রেন্ড’। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘বিজেপি ক্লিয়ার হয়ে গেল তা হলে?’’ আসলে কাউকে তিনি প্রশ্ন করেননি। ওটা ছিল স্বগতোক্তি। কিন্তু আমিরুদ্দিনের পাশে দাঁড়ানো মহম্মদ ইভরার ভাবলেন যে প্রশ্নটা তাঁর উদ্দেশে। কিছুটা নিস্পৃহ স্বরেই তাঁর উত্তর, ‘‘যা হচ্ছে আপনিও দেখছেন, আমিও দেখছি। কী আর বলব!’’
ভোটের ফলাফল যত পরিষ্কার হয়েছে, যত গেরুয়া আবিরের রং গাঢ় হয়েছে, ততই ফলাফলের প্রতি গার্ডেনরিচ, মেটিয়াবুরুজের প্রাথমিক দোলাচল কেটে নিস্পৃহ ভাব এসেছে। অন্তত প্রকাশ্যে। কোনও কোনও জায়গা দেখে বোঝার উপায় নেই যে, নির্বাচনের ফল বেরিয়েছে এ দিন। বটতলা রেললাইন মোড়ে কর্তব্যরত ট্র্যাফিক পুলিশকর্মী বলছিলেন, ‘‘এত শান্ত, এত ফাঁকা এলাকা কখনও দেখিনি।’’
সেই ‘অদ্ভুত’ শান্ত গার্ডেনরিচে কখনও-সখনও কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানদের গাড়ি এ দিন নজরে পড়েছে। কলকাতা পুরসভার ১৫ নম্বর বরোর আর্বান প্রাইমারি হেল্থ সেন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল মেটিয়াবুরুজ থানার গাড়ি। সঙ্গে জলপাই রঙের পোশাক পরিহিত কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ানেরা। ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রবিবার ভোট হয়েছিল। তার সামনে দাঁড়িয়ে এক পুলিশকর্মী বললেন, ‘‘এখানে সব চুপচাপ। সকলে যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত।’’ পাশে দাঁড়ানো কেন্দ্রীয় বাহিনীর জওয়ান বললেন, ‘‘সব পিসফুল হ্যায়।’’ মেটিয়াবুরুজের বাসিন্দা সাবির আহমেদ যদিও বলছিলেন, ‘‘শান্ত ব্যাপারটা তো আলাদা। এটা আসলে থমথমে একটা ব্যাপার। দেখছেন না পাশে দাঁড়ানো লোকের সঙ্গেও কথা বলছে না কেউ।’’
এ বারই প্রথম ভোট দিয়েছিলেন শাহনওয়াজ আলম। এ দিন ফলাফল পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার পরে বললেন, ‘‘দেখুন, যা ফল, তাকে মেনে নেওয়া উচিত। তবে একটা কথাই শুধু বলব, ধর্ম নিয়ে মাতামাতিটা বন্ধ হওয়া দরকার।’’ আক্রা রোডের রিকশাচালক রাজু শেখ বলছিলেন, অন্য দিন সকাল থেকে কতগুলো ‘ট্রিপ’ হয়। কিন্তু এ দিন সে সব কিছুই নেই। রাজুর কথায়, ‘‘ভোটের ফল দিয়ে তো আর পেট ভরবে না। আমাদের কী আছে? আমরা রিকশা চালাই, সেটাই চালাব। তবে যারা জিতল, তারা আমাদের কথাও যেন ভাবে।’’
নুরুল বলছিলেন, পূর্বাশা পুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চাবি তাঁর কাছে থাকে। ‘ভরসা’ করে তাঁর কাছেই চাবি দিয়ে যান স্কুল কর্তৃপক্ষ। রবিবার ওখানে ভোট হয়েছিল। এখন পুরো ফাঁকা। ফাঁকা স্কুলবাড়িতে কেউ ঢুকলেন বা সেখান থেকে কেউ বেরোলেন কি না, নজর রাখেন নুরুল। চাবিটা দেখাতে দেখাতেই তিনি বলছিলেন, ‘‘বিশ্বাস, ভরসাটাই তো আসল। সেটা থাকলেই সব ঠিক থাকে। আর সেটা না থাকলেই তো গোলমাল। ভোট বলুন, আমাদের জীবন বলুন, সব জায়গাতেই এটা ঠিক।’’
কত সহজ ভাবে কথাগুলো বলছিলেন নুরুল। যাবতীয় দোলাচল, নিস্পৃহ ভাব কাটিয়ে দিনের শেষে সেই ‘ভরসা’র হাত ধরতে চেয়েছে গার্ডেনরিচও।