উল্লাস: কামারহাটির ব্যবধান জানার পরে স্লোগান দিচ্ছেন তৃণমূল যুব বাহিনীর কর্মীরা। বৃহস্পতিবার। নিজস্ব চিত্র
বিকেল পাঁচটা। পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি ভোটের ব্যবধানে দলীয় প্রার্থী সৌগত রায় যে বিপক্ষকে পিছনে ফেলে দিয়েছেন, তা তখন সকলেই জেনে গিয়েছেন। তবু সবুজ আবিরে নিজেদের রাঙানো, মিষ্টিমুখ করা বা ঘন ঘন স্লোগানের চেনা ছবি নয়। বরং হাতে নোটবুক আর পেনসিল নিয়েই ব্যস্ত থাকলেন দমদম লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূলকর্মীরা। ৫০ মিটার দূরে থাকা বিজেপি শিবিরে তখন ‘আসছে বছর আবার হবে’ আবহ। আর ঠিক উল্টো দিকে দেড় লক্ষের বেশি ভোট পেয়ে দলীয় কমরেডদের সঙ্গে ফলাফলের বিশ্লেষণে ব্যস্ত সিপিএম প্রার্থী। গণনা কেন্দ্র থেকে নিরাপদ দূরত্বে পানিহাটির ধানকলে এটাই ছিল বৃহস্পতিবার বিকেলের ছবি।
সকালটা অবশ্য উদ্বেগ দিয়েই শুরু হয়েছিল। এ দিন বি টি রোডের ধারে তিন দলের শিবিরের মধ্যে আয়োজনে এগিয়ে ছিল তৃণমূলই। মাতঙ্গিনী ভবন লাগোয়া এলাকায় অস্থায়ী ছাউনির নীচে টেলিভিশনের পর্দায় চোখ আটকে ছিল দলীয় কর্মীদের। থেকে থেকেই কপালে উদ্বেগের ভাঁজ চওড়া হয়েছে জোড়াফুলের সমর্থকদের। আবার যে-ই শুনেছেন তৃণমূল প্রার্থী এগিয়ে, উল্লাসে ফেটে পড়েছেন তাঁরা।
প্রায় পঞ্চাশ মিটার দূরত্বে আড়াআড়ি অবস্থানে বিজেপি শিবিরে তখন জেলা সভাপতি মানস ভট্টাচার্য ঠান্ডা জলে ওআরএস মিশিয়ে ঢকঢক করে গলায় ঢালছেন। চট করে মোবাইলে গণনার ‘ট্রেন্ড’ দেখে নিয়ে বললেন, ‘‘কামারহাটির গণনা শুরু হওয়ার পরে যে ধাক্কাটা খেলাম, সেটাই রয়ে গিয়েছে।’’ দিনের শেষে সেই তালিকায় পানিহাটি, উত্তর দমদম, বরাহনগর যুক্ত হয়েছে।
সিপিএম শিবির তত ক্ষণে কী হতে চলেছে, তা আঁচ করে ফেলেছে। এক যুবক বিজেপি শিবিরে রাখা গেরুয়া চেয়ারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘এত গেরুয়া চেয়ার! ডেকরেটর্সের কাছে আগে তো শুধু লাল ও সবুজ চেয়ার পাওয়া যেত!’’
বেলার দিকে গোটা বাংলার মতো দমদমের আভাসও স্পষ্ট। তৃণমূল প্রার্থী তত ক্ষণে তিরিশ হাজার ভোটে এগিয়ে। সাড়ে ১২টার মধ্যেই কামারহাটির যুব তৃণমূলের বাইক-বাহিনী বি টি রোডের অর্ধেক দখল করে নেয়। বিকেল তিনটে নাগাদ স্লোগান তোলেন কামারহাটির তৃণমূল সমর্থকেরা। কিছু ক্ষণের মধ্যে সেখানে হাজির হয়ে পানিহাটির বিধায়ক নির্মল ঘোষ দলীয় কর্মী-সমর্থকদের স্লোগান না দেওয়ার অনুরোধ করেন। তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘‘সমঝতে না হো। রেজাল্টবা দেখো। তব তো বাত করো।’’
নেতা যখন এ কথা বলছেন, তখন পানিহাটির সাত নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূলকর্মী জন্টি দত্তের উপলব্ধি, ‘‘অনেক বুথে পিছিয়ে পড়েছি। বিধানসভায় এটা মেক-আপ করতে কী বেগ পেতে হবে জানেন!’’ বরাহনগরের এক তৃণমূলকর্মীর মন্তব্য, ‘‘আমার পার্টে বিজেপি ২৩২টি ভোট পেয়েছে। এত বিজেপি সমর্থক এল কোথা থেকে!’’ হাতে পেনসিল-নোটবুক ধরার আরও কারণ রয়েছে। তৃণমূল সূত্রের খবর, রাতে শেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, খড়দহ বিধানসভায় তৃণমূল প্রার্থী মাত্র ১২৪৮ ভোটে এগিয়ে ছিলেন। দমদম পুরসভা এ দিনের ফলের নিরিখে হাতছাড়া হয়েছে। রাজারহাট-গোপালপুরেও কমবেশি সাড়ে সাতশো ভোটে পিছিয়ে রয়েছে শাসকেরা। দক্ষিণ দমদম পুরসভার চেয়ারম্যানের ওয়ার্ডে মাত্র ২৪৭ ভোটে এগিয়ে তৃণমূল। তবে এ সবই রাত পর্যন্ত পাওয়া হিসেব।
সাড়ে চার লক্ষের বেশি ভোট পাওয়া বিজেপি প্রার্থী শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘আমি বলেছিলাম, সৌগত রায়কে বিশ্রাম দিতে এসেছি। তিনি আজ আমাকে বিশ্রামে পাঠিয়েছেন। তৃণমূলের আগ্রাসী সাংগঠনিক শক্তি ওঁকে আবার সংসদে পাঠিয়েছে। পানিহাটি ও কামারহাটিতে আমরা ধাক্কা খেয়েছি।’’ সিপিএম প্রার্থী নেপালদেব ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘দমদমের মানুষ যে সচেতন, তার আভাস এই ফলে রয়েছে। এখনও পর্যন্ত শুনেছি, ১৪ শতাংশ ভোট পেয়েছি। মেরুকরণের ভোটের টানাপড়েনে সেটাই
উল্লেখযোগ্য বিষয়।’’
দিনের শেষে ৫৩০০২ ভোটে জয়ী প্রার্থী সৌগত রায় বলেন, ‘‘বিজেপি যে এত ভোট পেয়েছে, তাতে আমি আশ্চর্য! এটা সিপিএমের দ্বিচারিতা। পরিকল্পনা করে সিপিএমের একাংশ নিজেদের ভোট বিজেপিকে দিয়েছে। গত বিধানসভা নির্বাচনে কামারহাটি, উত্তর দমদমে হেরেছিলাম। দু’টি বিধানসভাতেই আমরা এগিয়ে রয়েছি। রাজারহাট-গোপালপুরে কেন ফল খারাপ হল, তা সেখানকার বিধায়ক পর্যালোচনা করবেন।’’