আর জি কর

বেসরকারি ল্যাবের সঙ্গে চুক্তি, প্রশ্নের মুখে দরপত্রের শর্ত

নিখরচায় শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বেসরকারি ল্যাবরেটরি বেছে দিচ্ছে মেডিক্যাল কলেজগুলি। কিন্তু সেই ল্যাবে হওয়া পরীক্ষার মান কি আদৌ যথাযথ?

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৩ জানুয়ারি ২০১৭ ০১:৫২
Share:

নিখরচায় শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বেসরকারি ল্যাবরেটরি বেছে দিচ্ছে মেডিক্যাল কলেজগুলি। কিন্তু সেই ল্যাবে হওয়া পরীক্ষার মান কি আদৌ যথাযথ? দিন দশেক আগে এই প্রশ্ন তুলে স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তার দফতরে অভিযোগ জানিয়েছে রাজ্যের তিনটি ‘এনএবিএল’ (ন্যাশনাল অ্যাক্রিডিটেশন বোর্ড ফর টেস্টিং অ্যান্ড ক্যালিব্রেশন ল্যাবরেটরিজ) অ্যাক্রেডিটেড ল্যাবরেটরি। গত ২০ ডিসেম্বর দরপত্রের মাধ্যমে একটি বেসরকারি ল্যাবরেটরির সঙ্গে এ ভাবে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে কলকাতার আরজিকর মেডিক্যাল কলেজ। তিনটি ল্যাবরেটরির অভিযোগ এর প্রেক্ষিতেই।

Advertisement

অভিযোগে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য দফতরের তৈরি ওই দরপত্রে ল্যাবরেটরিগুলির যোগ্যতার শর্ত লেখার ক্ষেত্রে ফাঁক থেকে গিয়েছে। ফলে মুড়ি-মিছরির এক দর হয়ে যাচ্ছে। অভিযোগকারীদের দাবি, এর ফলে উপযুক্ত পরিকাঠামোহীন ল্যাবরেটরির সরকারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পথ তৈরি হচ্ছে। আর তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা সাধারণ রোগীদের, যাঁদের সরকারি হাসপাতাল থেকে ওই সব ক্লিনিকে বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য পাঠানো হবে।

রোগীদের সুবিধার্থেই মেডিক্যাল কলেজগুলির সঙ্গে বিভিন্ন বেসরকারি ল্যাবরেটরিকে চুক্তির ভিত্তিতে যুক্ত করার এই পরিকল্পনা নিয়েছে স্বাস্থ্য দফতর। যাতে যে সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা হাসপাতালে হয় না, সেগুলি ওই
সব ল্যাব থেকেই নিখরচায় করাতে পারেন রোগীরা।

Advertisement

উদ্দেশ্য মহৎ, তা মানছেন সকলেই। কিন্তু সমস্যা তৈরি হয়েছে দরপত্রের শর্ত নিয়ে। তাতে লেখা রয়েছে—‘এনএবিএল অ্যাক্রেডিটেড/ ইক্যুইভ্যালেন্ট’ ল্যাবরেটরি এই দরপত্রে অংশ নিতে পারবে। তবে এনএবিএল-এর ‘ইক্যুইভ্যালেন্ট’ বা ‘সমতুল’ বলতে কী বোঝানো হয়েছে তার কোনও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। সমস্যার সূত্রপাত সেখানেই। অভিযোগ, এর ফলে সাধারণ ‘আইএসও’ (ইন্টারন্যাশন্যাল অর্গানাইজেশন ফর স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন) সার্টিফিকেট-যুক্ত ল্যাবরেটরিরাও দরপত্রে অংশ নিচ্ছে। আরজিকর মেডিক্যাল কলেজের দরপত্রেও চারটি এনএবিএল অ্যাক্রেডিটেড ল্যাবরেটরিকে পিছনে ফেলে একটি আইএসও সার্টিফিকেট-যুক্ত ল্যাবরেটরি সরকারের সঙ্গে চুক্তির জন্য মনোনীত হয়েছে বলে অভিযোগ।

ভারত সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের অন্তর্গত স্বশাসিত সংস্থা এনএবিএল-এর অ্যাক্রেডিটেশন এ দেশে ল্যাবরেটরির গুণমান বিচারের সর্বোচ্চ মাপকাঠি। সংস্থার অন্যতম ইন্টার্নাল অডিটর কুমারজ্যোতি ঘোষের কথাতেও, ‘‘এনএবিএল এবং আইএসও কখনও, কোনও ভাবে সমতুল হতে পারে না। দুটো মাপকাঠি আলাদা। যে কোনও অফিস বা ল্যাবরেটরি তার কাজকর্ম সংক্রান্ত তথ্য কতটা ভাল ভাবে সংরক্ষণ করছে, তার উপরে আইএসও সার্টিফিকেশন হয়। আর ল্যাবরেটরির গুণমান বজায় রাখতে যে ব্যবস্থাগুলি নিতে বলা হল, তা সত্যিই নেওয়া হচ্ছে কি না একাধিক বার পরিদর্শন করে দেখে তবেই এনএবিএল অ্যাক্রেডিটেশন দেওয়া হয়।’’

স্বাস্থ্যকর্তারাও এখন মানছেন, এনএবিএল অ্যাক্রেডিটেশনের ‘সমতুল’ হিসেবে কোনও ল্যাবরেটরি তাদের আইএসও সার্টিফিকেট দেখিয়ে দরপত্রে অংশ নিলে, তা বৈধ হতে পারে না। কিন্তু আরজিকরে সেটাই হয়েছে। এক প্রবীণ স্বাস্থ্যকর্তার অভিযোগ, ‘‘দরপত্রের শর্তাবলী লেখার সময়ে বারবার ‘ইক্যুইভ্যালেন্ট’ শব্দটা তুলে দিতে বলেছিলাম। কিন্তু কিছু লোক কাটমানির জন্য কিছু ল্যাবরেটরিকে সুবিধা করে দিতে ওই শব্দটা রেখে দিলেন। আসলে সরকারি হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়া মানেই লক্ষ-লক্ষ টাকার ব্যবসা!’’

অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে আর জি করের সুপার প্রবীর মুখোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘কোনও অবৈধ কাজ হয়নি। আমি এনএবিএল থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছি। আমি জানি, এনএবিএল এবং আইএসও সমান। যে ল্যাবরেটরি বাছাই হয়েছে তাদের আইএসও সার্টিফিকেট আছে, অভিজ্ঞতা ও সুনাম আছে এবং তারা সরকারি দরে উপরে সবচেয়ে বেশি ৪৬.৫ শতাংশ ছাড়ও দিয়েছে।’’

আরজিকরের মনোনীত ল্যাবরেটরির ডিরেক্টর বিপুল সাঁইয়ের ব্যাখ্যা, ‘‘এনএবিএল বুঝি না, আমরা যারা স্বাস্থ্য ভবনের সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করেছি তারাই ‘ইক্যুইভ্যালেন্ট’। আমাদের কোনও সার্টিফিকেট দরকার হয় না। সকলেই চেনে।’’ বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য সরকারি রেটের উপরেও তারা যে বিপুল ছাড় দিচ্ছেন, তাতে পরীক্ষার মানের সঙ্গে আপস করার অভিযোগও উঠেছে। যা শুনে বিপুলবাবুর মন্তব্য, ‘‘আমাদের ‘ট্রেড সিক্রেট’ নিয়ে লোকের এত মাথাব্যথা কেন!’’a

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
আরও পড়ুন