বিতর্কিত: ভাঙার পরে ওল্ড কেনিলওয়ার্থ হোটেলের জায়গা। ছবি: রণজিৎ নন্দী
শহরে একের পর এক ঐতিহ্যবাহী বাড়ি ধ্বংস হয়ে ঐতিহ্য ‘বিপন্ন’ হতে বসেছে। এমনটাই মনে করছে রাজ্য হেরিটেজ কমিশন। তাই ঐতিহ্যের ‘নিয়ন্ত্রণ’ আর কলকাতা পুরসভার হেরিটেজ কমিটির হাতে ছাড়তে রাজি নয় কমিশন।
কমিশনের মতে, পুরসভার হেরিটেজ কমিটির তো আইনি বৈধতাই নেই। ফলে হেরিটেজ সংক্রান্ত আইনি ঝামেলা কমিশনকে সামলাতে হয়। অতএব শহরে হেরিটেজ সংক্রান্ত সিদ্ধান্তে তাদের যুক্ত করা হোক বা ওই সংক্রান্ত পুরো দায়িত্ব তাদের হাতে দিয়ে দেওয়া হোক। কমিশন সূত্রের খবর, কলকাতা পুর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে।
প্রসঙ্গত, শহরের ঐতিহ্যবাহী ভবন চিহ্নিত ও তা ঘোষণা করার কাজটা কলকাতা পুরসভার হেরিটেজ কমিটিই এত দিন করে এসেছে। যদিও রাজ্যের অন্যত্র হেরিটেজ ঘোষণার কাজ করে কমিশন। এ বিষয়ে রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের চেয়ারম্যান শুভাপ্রসন্ন বলেন, ‘‘পুরসভার সঙ্গে নতুন করে বসার পরিকল্পনা করছি। ঐতিহ্য সংরক্ষণে হয় পুরসভার হেরিটেজ কমিটির সঙ্গে কমিশনের সদস্যদের নিয়ে একটা যৌথ কমিটি তৈরি হোক অথবা শহরে হেরিটেজ সংক্রান্ত পুরো দায়িত্ব কমিশনকে দেওয়া হোক। এটা পরিষ্কার করতে হবে।’’
প্রসঙ্গত, লিটল রাসেল স্ট্রিটের ওল্ড কেনিলওয়ার্থ হোটেলটি ২০০৯ সালে পুরসভার হেরিটেজ তালিকা অনুযায়ী ‘গ্রেড টু-এ’ ছিল। যা কোনও ভাবেই ভাঙা যাবে না। কিন্তু একটি আবেদনের প্রেক্ষিতে পুরসভার হেরিটেজ কমিটি ২২৫ বছরের পুরনো ওই হোটেলকে ‘গ্রেড থ্রি’ করে দেয়। এর পরেই ভেঙে দেওয়া হয় ওই হোটেলের কিছু অংশ। হেরিটেজ বিশেষজ্ঞদের একাংশের প্রশ্ন, ওই হোটেল গ্রেডেশন তালিকার নীচে নেমে এল কীসের ভিত্তিতে? ফলে প্রশ্ন উঠেছে পুরসভার হেরিটেজ কমিটির ভূমিকা নিয়ে। শুধু তাই নয়, হেরিটেজ তালিকায় একের পরে এক অবনমন, তালিকা নিয়ে বিভ্রান্তি, এখনও প্রায় চারশোর বাড়িকে ‘গ্রেড পেন্ডিং’ তালিকাভুক্ত করে রাখা-সহ একাধিক বিষয়ে বারবার বিতর্কে পড়েছে পুরসভার হেরিটেজ কমিটি।
কমিশনের চেয়ারম্যানের বক্তব্য, ‘‘পুরসভার হেরিটেজ কমিটির সিদ্ধান্ত গ্রাহ্য হয় না। আদালত কমিশনের কাছেই হেরিটেজ সংক্রান্ত সব বিষয় জানতে চায়।’’ কমিশনের সদস্য তথা হেরিটজ স্থপতি পার্থরঞ্জন দাশ বলেন, ‘‘পুরসভার হেরিটেজ কমিটি কোনও বাড়ি বা ভবনের শুধু ঐতিহাসিক দিকটি দেখে। কিন্তু আইনের চোখে ওই কমিটির বৈধতা নেই।’’
কমিশন মনে করছে, হেরিটেজ বিতর্ক আটকাতে প্রথম কাজই হল হেরিটেজ নিয়ে কড়া আইন করা। কারণ, এই মুহূর্তে হেরিটেজ সংক্রান্ত যে আইন রয়েছে, তাতে অনেক ধোঁয়াশা আছে। যেমন কারও বাড়ি হেরিটেজ হলে তা সারানোর ক্ষেত্রে অনেক বিধিনিষেধ রয়েছে। পাশাপাশি আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় ঐতিহ্যবাহী ভবনের বাসিন্দাদের বাড়ি সারানোর ব্যাপারে বিপদে পড়তে হচ্ছে। হেরিটেজ বাড়ির ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ রেখেই তাকে বিকল্প আয়ের উৎস হিসেবে কী ভাবে ব্যবহার করা যায়, তা কমিশনের আলোচনায় উঠে আসছে। যাতে ঐতিহ্য রক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মালিক বাড়িটির রক্ষণাবেক্ষণও করতে পারেন। শুভাপ্রসন্নের বক্তব্য, ‘‘হেরিটেজ ঘোষিত হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট বাড়ির মালিককে কিছু করতে দেব না, সেটা সমাধান নয়। সে কারণেই গোপনে অনেক ঐতিহ্যবাহী বাড়ি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ আইন তৈরি না হলে হেরিটেজের ধ্বংস আটকানো যাবে না।’’
পুরসভার হেরিটেজ কমিটির এক সদস্যের কথায়, ‘‘কলকাতা পুরসভা স্বশাসিত সংস্থা। পুরসভার হেরিটেজ কমিটিও তাই। সে ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার আদৌ হস্তক্ষেপ করতে পারে কি না, সেটা দেখার বিষয়।’’