সিরিঞ্জের মাধ্যমে মাদক নিচ্ছেন এক নেশাগ্রস্ত। নিজস্ব চিত্র
স্কুলে আমার কয়েক জন বড়লোক বন্ধু ছিল। দু’-এক জন তো বিদেশি গাড়ি চড়ে আসত। তাদের এক জন আমার খুব ঘনিষ্ঠ ছিল। ওই বন্ধুদের সঙ্গেই অষ্টম-নবম শ্রেণিতে গল্ফ খেলতে শুরু করি। সেখানেই জুটেছিল আমাদের থেকে বয়সে বড় কয়েক জন ‘বন্ধু’। খেলার ফাঁকেই দূরে, আড়ালে গিয়ে ওদের সিগারেট খেতে দেখতাম। সিগারেটের ভিতরে আসলে গাঁজা থাকত। তাদেরই এক জন ডেকে প্রথম গাঁজা খাইয়েছিল এক দিন। খেয়ে বেশ ভাল লেগেছিল। তার পর থেকে মাঝেমধ্যেই গাঁজা খেতে শুরু করি। তখনও আমার দশম শ্রেণির বোর্ড পরীক্ষা হয়নি।
এই সময়েই এক দিন আমার সেই ঘনিষ্ঠ বন্ধু নিজের জন্মদিনের পার্টিতে ডেকেছিল। ওদের বাড়ি গিয়ে শুনলাম, ওর দাদা ভাইয়ের জন্মদিনের উপহার হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে এলএসডি ব্লটস নিয়ে এসেছে। আমাকে বলল, ‘নিবি?’ ততদিনে গাঁজা খাচ্ছি। আমি তখন দশম শ্রেণি। সে দিন বন্ধুর বাড়িতে ওর দাদার সঙ্গে ব্লটস নিলাম। ওর দাদা, দাদার এক বন্ধু আর আমি— তিন জনে নিলাম। বন্ধু নিল না।
ব্লটস আসলে ছোট ট্যাবলেটের মতো দেখতে। জিভের তলায় রেখে দিলে আধ ঘণ্টায় গলে যায়। তার পরে শুরু হয় ‘কিক’। একটানা ৮ ঘণ্টা ঘোর থাকে। হ্যালুসিনেশন হয়। চোখের সামনে নানা রকম আকার-আকৃতি ফুটে ওঠে। রক্তচাপ বেড়ে যায়। কী রকম একটা অস্থিরতা তৈরি হয়। উফ, দারুণ লেগেছিল প্রথম দিন! বুঝতে পেরেছিলাম, সে দিন বাড়ি ফেরা সম্ভব নয়। বাড়িতে ফোন করে বলেছিলাম, বন্ধুর বাড়ি থেকে যাব।
সে দিনের পরে হ্যালুসিনেশনের নেশা পেয়ে বসে। আমি বাইরে এলএসডি ব্লটস খুঁজতে শুরু করি। ইতিমধ্যে আমার আইসিএসই পরীক্ষা শেষ হয়। একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হই নতুন স্কুলে। ক্লাসের সঙ্গেই চলতে থাকে ব্লটসের নেশা। গাঁজাও খেতাম মাঝেমধ্যে। বেশির ভাগ সময়েই চোখ লাল হয়ে থাকত। বাড়িতে জানতে চাইলে বলতাম, শরীরটা ভাল নেই। ক্লান্ত হয়ে আছি। গন্ধ যাতে না পাওয়া যায়, তার জন্য সব সময়ে চিউইংগাম সঙ্গে রাখতাম। আমার ছোট বোন আছে। ও কখনও কিছু বুঝতে পারেনি।
এই শহরের প্রচুর জায়গায় ব্লটস পাওয়া যায়। এক-একটা ব্লটসের দাম ১৮০০ থেকে ২০০০ টাকা। কোনও না কোনও ভাবে টাকা জুটেই যেত। গল্ফের বল কিনব বলে মাঝেমধ্যেই বাবা-মায়ের কাছ থেকে টাকা চাইতাম। তা দিয়ে ব্লটস কিনতাম। খেলতে যেতাম না। এর পরে নেশার টানে নিজের বাড়িতেই চুরি করতে শুরু করি। দ্বাদশ শ্রেণির পরে একটি বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি করিয়ে দেয় বাবা। তখন একটি মেয়ের সঙ্গে আলাপ হয়। আমাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। সেই বান্ধবীও আমার সঙ্গে ব্লটস নিত।
স্কুলে যারা ভাল বন্ধু ছিল, তারা বুঝতে পেরেছিল আমার নেশা করার বিষয়টা। ওরা মদ খেত, সিগারেট খেত। কিন্তু ব্লটস নিত না। আমাকে ফোন করে, দেখা করে বোঝানোর চেষ্টা করত ওরা। কিন্তু আমার খুব বিরক্ত লাগত। তাই আস্তে আস্তে ওদের থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলাম। কলেজে বান্ধবী ও অন্যদের সঙ্গে এর পরে কোকেন, এমডিএমএ ট্যাবলেটও নিতে শুরু করি। এই নেশা করার সময়ে পড়াশোনা যে খুব ভাল হচ্ছিল, তেমন নয়। কিন্তু মনে হত, ঠিক সামলে নেব। পড়াশোনা শেষ করে চাকরি পেতে হবে, টাকা রোজগার করতে হবে— এমন কোনও চাপ তো ছিল না আমার উপরে।
মাস কয়েক আগে থেকে শরীর বেশ খারাপ লাগতে শুরু করে। বুঝছিলাম, নেশা করা বন্ধ করতে হবে। কিন্তু চেয়েও পারছিলাম না। এখন বাবা-মাকে ছেড়ে, বাড়ি ছেড়ে নেশামুক্তি কেন্দ্রে বসে আছি। শরীর এখন অনেকটাই ভাল। মনে হচ্ছে, অন্ধকার কুয়োর ভিতর থেকে কেউ যেন আমাকে টেনে তুলেছে। নেশা করার ইচ্ছেটা এখন হারিয়ে গিয়েছে।