ধর্মতলার ফুটপাথ ধরে হাঁটছিলেন শর্মিলি দাস। দু’ হাতে প্রায় বোঝাই করা ব্যাগ। হঠাত্ করেই ধাক্কা খেয়ে ব্যাগ সমেত পড়ে গেলেন রাস্তায়। পাশেই দাঁড় করানো গাড়ি আচমকা দরজা খুলে যাত্রী নামাচ্ছে। সারি সারি গা়ড়ি ফুটপাথ ঘেঁষে পার্ক করানো। নিয়মে নেই। না-থাকলেও বা তোয়াক্কা করছে কে?
গ্র্যান্ড হোটেলের ঠিক উল্টো দিকে দাঁড় করানো অনলাইনে বুক করা বিভিন্ন ট্যাক্সি। ফোনে বুক করার পর যাত্রী এসে পৌঁছানো পর্যন্ত অপেক্ষার জন্য চালকেরাও বেছে নিয়েছেন সেই ধর্মতলা লাগোয়া পার্কস্ট্রিট উড়ালপুলের মুখ।
শুধু ধর্মতলা নয়, কলকাতার অধিকাংশ জায়গাতেই এই বেআইনি পার্কিং আগেও চলে এসেছে, এখনও বর্তমান। যানজট কমাতে মুখ্যমন্ত্রী চিরকালই আস্থা রেখেছেন উড়ালপুলে। যানজট কমা তো দূর অস্ত দুর্ঘটনার তালিকায় জুড়েছে একের পর এক উড়ালপুল এবং সেই সংলগ্ন এলাকা। যে কোনও উড়ালপুলের ঠিক মুখেই এমন বেআইনি পার্কিং বস্তুত উড়ালপুল থেকে আসা এবং নীচে সার দিয়ে থাকা গাড়ি দুইয়ের পক্ষেই মারাত্মক। খোদ শহরের প্রাণকেন্দ্রের অবস্থাই বলে দিচ্ছে শহরের অন্যান্য অঞ্চলের কী অবস্থা।
পার্কস্ট্রিট উড়ালপুলের ঠিক মুখই এমন অবৈধ পার্কিংয়ের স্বর্গরাজ্য। পার্কিংয়ে থাকা এক ট্যাক্সি চালক জানান, ধর্মতলায় বাজার করতে এসে প্রায় সবাই এখানেই গাড়ি রেখে যায়। কিন্তু রাস্তার উপরে এভাবে গাড়ি রাখা তো বেআইনি। ‘‘আমাদের এখানে সব কী আর আইন মেনে হয়? ’’— নির্লিপ্ত হেসে উত্তর ওই চালকের। মজার ব্যাপার এই যে, এই এলাকায় যখন বেআইনিভাবে গাড়ি রাখতে গিয়েও স্থান সংকুলান হচ্ছে না, তখন নিউমার্কেট লাগোয়া সিম্পলেক্স প্রোজেক্টের করা মাটির নীচে পার্কিং প্রায় অর্ধেকের উপর খালি। এমনটা কেন?
গাড়ি নিয়ে যারা আসেন তাঁরা অনেকেই এখানে টাকা দিয়ে গাড়ি রাখার চেয়ে জওহরলাল নেহেরু রোডের উপর গাড়ি রাখতেই বেশি ভালোবাসেন। সময়টাও অনেক কম লাগে—জানান ওই পার্কিংয়েরই এক কর্মী। রাউডন স্ট্রিটের পার্কোম্যাটের মধ্যে প্রায় ২৮০ টি গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা থাকলেও গড়ে মাত্র ১০০টির মতো গাড়ি পার্ক হয় নিয়মিত। বেআইনি পার্কিং নিয়ে বহুবার কলকাতা কর্পোরেশনের বহু বিধি চালু হয়েছে, লঙ্ঘনও। তবুও সমস্যার কোনও সুরাহাই দেখাতে পারেনি কর্পোরেশন। ফলত উড়ালপুলের নীচে এমন পার্কিং বাড়াচ্ছে যানজট এবং দুর্ঘটনা। শুধু পথচারী নয়, ধর্মতলার ফুটপাথে যেসব দোকানগুলি রয়েছে পার্কিংয়ের ভিড়ে সমস্যা হচ্ছে তাঁদেরও। এক ব্যাবসায়ী জানান, পুজোর সময় পরিস্থিতি থাকে ভয়ঙ্কর। রাস্তার ধার দখল করে গাড়ি রেখে সবাই বাজারে বা হোটেলে চলে যান। ‘‘এই এলাকায় ভিড় এমনিই বেশি, গাড়ি পার্কিংয়ের ফলে আরও হাঁসফাঁস অবস্থা হয়। কিন্তু সবার এখন এটা অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে।’’—বলেন আরেক ফুটপাথ ব্যাবসায়ী।
ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারদের মতে, যেকোনও উড়ালপুলে গাড়ির গতি থাকে স্বাভাবিকের থেকে বেশি, সেকারণে উড়ালপুলের মুখের ১০০ মিটারের মধ্যে কোনও ভাবেই কোনও পার্কিং বেআইনি। পার্কিংয়ে থাকা কোনও গাড়ি বেরোতে গিয়ে বা পার্ক করতে গিয়ে উড়ালপুল থেকে তীব্রগতিতে আসা কোনও গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে। এ সমস্যা নতুন নয়, সব জেনে শুনেও কেন কোনও ব্যাবস্থা নিচ্ছে না কলকাতা পুরসভা?
মেয়র পারিষদ দেবাশিস কুমার জানান আগামী সপ্তাহের মধ্যেই এই বেআইনি পার্কিং বিষয়ে নতুন করে ব্যাবস্থা নিতে চলেছে পুরসভা। তিনি বলেন, ‘‘এর আগেও যে চেষ্টা হয়নি তা নয়। তবে হতাশার কোনও জায়গা নেই। আগের থেকে অবস্থা অনেকটাই বদলেছে। বারে বারে চেষ্টা করে আরও বদলাবে।’’ আর্থিক জরিমানা করে কী কোনওভাবে রোখা যেতে পারে এই প্রবণতা? মেয়র পারিষদের উত্তর, ‘‘সমস্ত দায় একা পুরসভার নয়, মানুষ যদি সচেতন না হয় কোনও নিয়ম করেও এই প্রবৃত্তি আটকানো যাবে না।’’ একই বক্তব্য কলকাতা ট্রাফিক পুলিশেরও। ট্রাফিক পুলিশের এক কর্তা জানান, কলকাতা পুলিশের তরফে বরাবরই চেষ্টা করা হয়েছে, এখনও হচ্ছে। শহরের বিভিন্ন জায়গায় অবৈধ পার্কিং দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে ব্যাবস্থা নেওয়া হচ্ছে। পুরসভা হোক বা পুলিশ—ঢালাও আশ্বাস কিন্তু ঢেকে দিতে পারছে না শহরের নিয়মহীন পার্কিংয়ের ছবিটা।