বর্ষশেষের রাত: ভিড়ের সঙ্গে উচ্ছৃঙ্খলতাও

রাত সাড়ে বারোটা। পার্ক স্ট্রিট। এক পুলিশ অফিসারের গায়ে মোটরবাইকটা তুলেই দিচ্ছিলেন বেসামাল যুবক। তাঁকে পাকড়াও করে থানায় নিয়ে যান কয়েক জন পুলিশকর্মী। পরিস্থিতি গোলমেলে বুঝে পদস্থ অফিসারেরাও লাঠি নিয়ে নেমে পড়েন রাস্তায়।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০১৬ ০১:১৪
Share:

বছর শেষের রাত। পার্ক স্ট্রিটে উদ্দাম উল্লাস।

রাত সাড়ে বারোটা। পার্ক স্ট্রিট। এক পুলিশ অফিসারের গায়ে মোটরবাইকটা তুলেই দিচ্ছিলেন বেসামাল যুবক। তাঁকে পাকড়াও করে থানায় নিয়ে যান কয়েক জন পুলিশকর্মী। পরিস্থিতি গোলমেলে বুঝে পদস্থ অফিসারেরাও লাঠি নিয়ে নেমে পড়েন রাস্তায়। এক সময়ে মত্ত, বিশৃঙ্খল যুবকদের রীতিমতো পেটাতে শুরু করে পুলিশ।

Advertisement

বৃহস্পতিবার বর্ষবরণের রাতে উ়ৎসাহীদের ‘সামলাতে’ বিনোদনের কেন্দ্রস্থল পার্ক স্ট্রিট ও তার লাগোয়া অঞ্চলের পাশাপাশি পুলিশকে নানা রকম ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে সল্টলেক-নিউ টাউন চত্বরেও। কারণ উৎসব-উল্লাসে ‘বিকেন্দ্রীকরণ’ ঘটিয়ে শহরের পূর্ব দিক সল্টলেক-নিউ টাউনও এখন উদ্‌যাপনের নতুন ঠিকানা।

লালবাজার সূত্রে খবর, বছর শেষের রাতে শহরের রাস্তা থেকে মোট ৩২৬ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে ৯৭টি মোটরবাইক। বিধাননগর কমিশনারেট এলাকায় গ্রেফতার ৪০। তবে অনেকেই জামিনে ছাড়াও পেয়ে যান।

Advertisement


সেখানে ভিড় সামলাতে নিজেই লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে যাচ্ছেন পুলিশের এক কর্তা।

কলকাতা

বর্ষশেষের সন্ধ্যা থেকেই ভিড় ছিল পার্ক স্ট্রিটে। রাত পৌনে বারোটা থেকে তা বাড়ে। আগের বছরগুলির অভিজ্ঞতা থেকে পুলিশ মিডলটন রো, রাসেল স্ট্রিট, মির্জা গালিব স্ট্রিট, পার্ক স্ট্রিট-মল্লিকবাজার মোড়ের মতো বেশ কিছু জায়গায় ব্যারিকেড বসায়। ছিল প্রচুর বাহিনীও। বারোটা বাজতে না-বাজতেই সব ব্যারিকেড ভেঙে পড়ে উৎসাহীদের ভিড়ে। অভিযোগ, তার মধ্যে মহিলাদের শ্লীলতাহানির চেষ্টাও চলে।

মূলত বেপরোয়া মোটরবাইক আর হুজুগে জনতার জোড়া ফলাতেই বর্ষবরণের শহরে নাকাল হয়েছে পুলিশ। পার্ক স্ট্রিটে মত্ত অবস্থায় দুই যুবক মহিলাদের সঙ্গে অভব্য আচরণ করছিল। তা আটকাতে যান স্থানীয় থানার সাব-ইনস্পেক্টর সমীরকুমার দত্ত। অভিযোগ, তাঁকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় যুবকেরা। মিডলটন রো-এ এক ডিসি-র উপরে চড়াও হন মত্ত এক তরুণী ও তাঁর সঙ্গী। রীতিমতো ধাক্কা মারা হয় ওই পুলিশকর্তাকে। তরুণীর হাত থেকে কোনওমতে নিজেকে ছাড়িয়ে এনে পুলিশকর্তার মন্তব্য, ‘‘এই ধরব আর এই ছাড়ানোর জন্য ফোন আসবে!’’ কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) সুপ্রতিম সরকার শুক্রবার জানান, স্বভূমিতে পুলিশকে নিগ্রহের জন্য বিদিশা আচার্য এবং দেবজ্যোতি রায়কে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাঁরা রিজেন্ট পার্কের বাসিন্দা বাড়ি। পার্ক স্ট্রিট থানার অফিসারকে নিগ্রহের জন্য সুনীত সিংহ ও সুরজ শীলকে গ্রেফতার করা হয়েছে।


শহরের এক নাইট ক্লাবে উষ্ণ উদ্‌যাপন।

শহরের তিনটি দুর্ঘটনাও ঘটে। মৃত্যু হয়েছে এক যুবকের। আহত তিন জন। পুলিশ জানায়, রাত একটা নাগাদ রাসবিহারী কানেক্টরে একটি ট্যাক্সির সঙ্গে ধাক্কায় মোটরবাইক উল্টে যায়। আহত হন বাইকচালক পবর সিংহ। আড়াইটে নাগাদ হেস্টিংসের কাছে মোটরবাইক উল্টে আহত হন সৌরভ পণ্ডিত ও মৃণাল ঘাটা নামে দুই যুবক। শুক্রবার ভোরে সোনারপুর থানার চণ্ডীতলায় একটি মোটরবাইক গ্যারাজে ধাক্কা মারে। পিছনে বসা জয়ন্ত কুণ্ডু (২৭) ঘটনাস্থলেই মারা যান। গুরুতর আহত বাইকচালক প্রসেনজিৎ দাস।

লালবাজারের সূত্র বলছে, পুজোর সময় থেকেই বেপরোয়া মোটরবাইক চিন্তা বাড়িয়েছিল পুলিশের। সম্প্রতি ক্রাইম কনফারেন্সে পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থ বাহিনীর প্রশংসা করলেও বর্ষশেষের রাতে মোটরবাইক নিয়ন্ত্রণে আরও সতর্ক হতে বলেছিলেন। কিন্তু পুলিশি কড়াকড়ি সত্ত্বেও দাপিয়ে বেড়িয়েছে মোটরবাইক। প্রায় প্রতিটিতেই তিন জন করে হেলমেট-হীন সওয়ারি। তা ঠেকাতে শেষে রীতিমতো মারমুখী মেজাজ নিয়ে নামেন পুলিশের বড়কর্তারা। তখন উপদ্রব থামলেও, তা আগেই ঠেকানো যেত কি না, সে প্রশ্ন রয়েই যায়।

বেসামাল জনতা আর বেপরোয়া মোটরবাইকের মাঝে বছরের শেষ রাতে পার্ক স্ট্রিটে ছিল আনন্দের ছবিও। যেমন ঢোল নিয়ে মেতেছিল একটি দল। সেখানে বিসর্জনের নাচ নাচছিলেন এক যুবক। মিছিল করে ঘুরলেন বৈষ্ণবেরাও। উৎসবে সামিল হন বিদেশি পর্যটকেরাও। ছিলেন চার্লি চ্যাপলিন সাজা সেই যুবকও।

সল্টলেক-নিউ টাউন

নিউ টাউনের ইকো পার্ক, সল্টলেকের নিক্কো পার্কই হোক বা বাগুইআটি, চিনার পার্কের শপিং মল, রেস্তোরাঁ— উদ্‌যাপনের ভিড় সর্বত্রই। বিশেষত উত্তর শহরতলির বহু মানুষ গত কয়েক বছর ধরে ৩১ ডিসেম্বর এই সব এলাকায় ভিড় জমাচ্ছেন। কয়েক বছর আগে পর্যন্ত যে ভিড় সল্টলেকের শপিং মল-নলবন-নিক্কো পার্কেই আটকে থাকত, এখন তার প্রধান অকর্ষণ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিকল্পনায় একটি সাধারণ ঝিলের ভোলবদলে তৈরি হওয়া ইকো পার্ক।

পার্কটি হওয়ার পরে এ বারই ছিল প্রথম বর্ষবরণ। বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই সেখানে ছিল উপচে পড়া ভিড়। তবে কর্তৃপক্ষ আর প্রশাসনের কড়া নজর থাকায় উদ্যামতা উচ্ছৃঙ্খলতায় গড়ায়নি। রাত ১২টা পর্যন্ত ওয়াচ টাওয়ারে নজরদারি চালান হিডকোর চেয়ারম্যান দেবাশিস সেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘বর্ষবরণের রাতটা সকলেই যাতে উপভোগ করতে পারেন, তাই একেবারে স্বল্প প্রবেশ মূল্য রাখা হয়েছিল। সারা দিনে ত্রিশ হাজারের বেশি মানুষ এসেছেন। রাতে তিন হাজারের কাছাকাছি ভিড় ছিল।’’ যদিও রাত ১২টার পরে অনুষ্ঠান শেষে কিছু তরুণকে মারামারিতেও জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। স্থানীয় রক্ষীদের তৎপরতায় তা বেশি দূর গড়ায়নি।


নিক্কো পার্কে চলছে ভাঙচুর।

ইকো পার্কের কয়েক কিলোমিটার দূরেই নিক্কো পার্কে আবার উদ্দামতা উচ্ছৃঙ্খলতায় পৌঁছোয়। খাবার, পানীয় না পাওয়ার অভিযোগে গোলমাল শুরু হয় সেখানে। চেয়ার-টেবিল উল্টে দিয়ে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজকদের ঘেরাও করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ এলে পুলিশ আধিকারিকদের সঙ্গেও ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। সময়ের আগেই অনুষ্ঠান বন্ধ করতে বাধ্য হয় পুলিশ। ঘটনাস্থলেই কয়েক জনকে আটক করা হয়।

পুলিশ জানায়, রাত বারোটার পরে ভিআইপি রোড, নিউ টাউনের মেজর আর্টেরিয়াল রোডে তরুণ-তরুণীদের বাইক নিয়ে ইতস্তত দাপাদাপি চোখে পড়েছে। বেপরোয়া ভাবে বাইক চালাতে গিয়ে ইকোপার্কের কাছেই দুই বাইক আরোহী দুর্ঘটনায় পড়েন। তাঁদের স্থানীয় নার্সিংহোমে ভর্তি করা হয়েছে।

ছবিগুলি তুলেছেন সুদীপ্ত ভৌমিক, রাসবিহারী দাস ও শৌভিক দে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement