Interfaith Marriage

ভিন্‌ধর্মী যুগলের জেদে রঙিন দেশের শপথ

গত কয়েক দিনে এই দু’টি দেশের সঙ্গেই দেখা হয়ে গিয়েছে মুদাস্‌সির আহমেদ জ়াকরি এবং সমৃদ্ধি ভোঁসলের।

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২১ ০৬:৩১
Share:

প্রতীকী ছবি।

ঠিক যেন দু’টি আলাদা দেশের লড়াই। এক পক্ষ, ধর্মের নামে কে কাকে ভালবাসবে, বিয়ে করবে, তা নিয়ে চোখ রাঙায়। আর এক পক্ষ ধর্মের বেড়া ভেঙে সবার রঙে রং মেশাতে মরিয়া। আবহমান ইতিহাস, সহিষ্ণুতার কসম খেয়ে সেই রঙিন ভারত রুখে দাঁড়ায় বিভেদের অন্যায় জুলুমের বিরুদ্ধে।

Advertisement

গত কয়েক দিনে এই দু’টি দেশের সঙ্গেই দেখা হয়ে গিয়েছে মুদাস্‌সির আহমেদ জ়াকরি এবং সমৃদ্ধি ভোঁসলের। ধর্মের বেড়া ভেঙে বিদ্বেষ, ছুতমার্গের উজান ঠেলে কলকাতাতেই ঘর বাঁধতে চলেছেন তাঁরা। ‘‘দিওয়ালি, শিবরাত্রিতে মন্দিরে গিয়েছি! ঈশ্বর মানি...কিন্তু ধর্মের মতো একটা ব্যক্তিগত ব্যাপারের জন্য ভালবাসার মানুষটাকে অস্বীকার করব, কেন?’’— শনিবার এ শহরের নতুন আস্তানায় বলছিলেন বিলাসপুরের মেয়ে, ২৬ বছরের সমৃদ্ধি ভোঁসলে। তিনি বোঝেন না, ‘‘এর আগে একটি মরাঠি ছেলেকে অল্প-অল্প ভাল লাগার সময়ে তো মা নিজেই আমায় প্রেম করতে বলত, পছন্দের মানুষটা মুসলিম বলে সেই পরিবারই কেন এমন বদলে গেল!’’ পাশে কলকাতার বাসিন্দা, ২৮-এর যুবক মুদাস্‌সির মিটিমিটি হাসেন, ‘‘আমিও ধর্মের সব নিষেধ সব সময়ে মানতে পারি না। ধর্মের জন্য ভালবাসাকে অস্বীকারের কোনও প্রশ্নই ওঠে না।’’

রূপকথার গল্পে রাজপুত্তুরই পাতালপুরীর বন্দিনী রাজকন্যাকে উদ্ধার করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে কিন্তু ঝড়ঝাপ্টা সয়ে সমৃদ্ধিই বন্দি-জীবনের শিকল ছিঁড়ে কলকাতায়। মুদাস্‌সিরের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক জানাজানি হতে ফোনটাও কার্যত কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। ২০২০-র ফেব্রুয়ারিতে কলকাতার চাকরি পাল্টানোর ফাঁকে বিলাসপুরে গিয়েছিলেন সমৃদ্ধি। এর পরেই ১৩ মাসের বন্দি-জীবন। নতুন চাকরিতেও যোগ দিতে পারেননি। সেপ্টেম্বরে ফের রায়পুরে অন্য চাকরিতে যোগ দেওয়ার পরেই তলে তলে ভালবাসার কাছে ফেরার পথ খুঁজছিলেন তিনি।

Advertisement

চার বছর আগে কর্পোরেট সংস্থার চাকরির তালিম-পর্বে দু’জনের দেখা ও বন্ধুতা গুজরাতের গাঁধীনগরে। কয়েক মাস পর থেকে দু’জনেই চাকরি করেছেন কলকাতায়। প্রেমের পথে কাঁটায় কেউই অবাক হননি। তবে কলকাতার প্রিয়াঙ্কা-রিজ়ওয়ান বা দিল্লির শাহজ়াদি-অঙ্কিতের মতো পরিণতিকেই ভবিতব্য বলে মানতে চাননি নাছোড় প্রেমিক-প্রেমিকা। এ দেশে ভিন্ ধর্মের দম্পতিদের সহায়তায় শরিক একটি মঞ্চের সাহায্যে আসিফ ইকবালের নম্বরটা খুঁজে সমৃদ্ধিই যোগাযোগ করেন প্রথমে। এর পরে তাঁকে বাড়ি থেকে উদ্ধারে কলকাতার বন্ধু সমাজকর্মী বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেন আসিফ।

গত সোমবার বাড়ির অত্যাচার চরমে পৌঁছেছিল। মা, মাসতুতো দাদারা তরুণীকে মারধর করেছেন। ফোনে মুদাস্‌সিরকেও হুমকি দিয়ে বিলাসপুরে ডাকা হচ্ছিল। প্রেমিকের এবং নিজের জীবনের জন্যও ভয় পাচ্ছিলেন সমৃদ্ধি। আসিফ ও বাপ্পাকে ইমেলে সব জানিয়ে সাহায্য চান তিনি। এর পরেই বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার বন্ধুদের মধ্যে ফোনপর্ব চলতে থাকে কলকাতা, দিল্লি, রায়পুর, বিলাসপুরেও। দিল্লির অংশু গুপ্ত, রায়পুরের আনন্দ শুক্ল, কলকাতার সায়ন্তনী বসাকদের চেষ্টায় আসরে নামেন ছত্তীসগঢ় হাইকোর্টের প্রিয়াঙ্কা শুক্ল। সমৃদ্ধির ইমেলের ভিত্তিতে মহিলা পুলিশের সাহায্যে তিনিই তরুণীকে বাড়ি থেকে উদ্ধার করেন। স্থানীয় প্রশাসনের কাছে নিজের বিবৃতি দিয়ে প্রিয়াঙ্কার সাহায্যেই বৃহস্পতিবার রাতে সমৃদ্ধি ফেরেন কলকাতায়। ওই আইনজীবীর কথায়, ‘‘মেয়েটির আত্মীয়েরা বিজেপি-ঘনিষ্ঠ বলে দুশ্চিন্তা ছিল। কিন্তু আমি বুঝতে পারি, ও ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্তটা নিয়েছে। এটা একটি মেয়ের নিজের মতো বাঁচার লড়াই বলেই দেখছি।’’

সমৃদ্ধি বা মুদাস্‌সির, কেউই ধর্মান্তরের কথা ভাবেননি। স্পেশ্যাল ম্যারেজ অ্যাক্টে বিয়ে করতে চান। মুদাস্‌সির হাসেন, ‘‘আমাদের সন্তানও নিজেই তার ধর্ম নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।’’ গুনগুনিয়ে গাইতে গাইতে প্রেমিকের কাঁধে মাথা রাখেন সমৃদ্ধি। দোলের ভারতবর্ষে রঙিন দেশের নিশান।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন