২৫ না ২৮, বলতে পারলেই হাতে আসছে আইপিএলের টিকিট!

রেড রোডের ধারে আইপিএলের টিকিট কাউন্টারের সামনে এই ছবিটা এখন প্রায় রোজই দেখছেন শহরবাসী। বুঝতে পারেন, দীনেশ কার্তিক, রোহিত শর্মা, অজিঙ্ক রাহানের ছক্কা হাঁকানো দেখার ‘ছাড়পত্র’ কিনতেই ভিড় করেছেন ওই মানুষগুলো।

Advertisement

শান্তনু ঘোষ ও সুদীপ্ত ভৌমিক

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০১৯ ০০:০০
Share:

সারিবদ্ধ: আইপিএলের টিকিট কাটার লাইন। মঙ্গলবার, ইডেনের সামনে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক

ভোর থেকে ওঁরা লাইনে দাঁড়িয়ে। চাঁদিফাটা রোদে নিজেরা নাজেহাল, সঙ্গে থাকা শিশুরাও। কান্না থামাতে কারও হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে কাঠি আইসক্রিম, কারও হাতে বরফ দেওয়া শরবত।

Advertisement

রেড রোডের ধারে আইপিএলের টিকিট কাউন্টারের সামনে এই ছবিটা এখন প্রায় রোজই দেখছেন শহরবাসী। বুঝতে পারেন, দীনেশ কার্তিক, রোহিত শর্মা, অজিঙ্ক রাহানের ছক্কা হাঁকানো দেখার ‘ছাড়পত্র’ কিনতেই ভিড় করেছেন ওই মানুষগুলো। যদিও ভোর থেকে গরমে ঘেমে-নেয়ে যাঁরা ওই লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন, তাঁদের বেশিরভাগই কিন্তু জানেন না কে দীনেশ, কে-ই বা রোহিত। আর রাহানের নাম তো বোধহয় জীবনে শোনেননি কেউ। তবে মলিন শাড়ি পরা বৃদ্ধা থেকে তরুণী আর দীর্ঘ দিনের না-কাচা জিন্স, ছেঁড়া গেঞ্জি পরা ছেলেদের দল শুধু জানে, ‘২৫-২৮’। অর্থাৎ, কোন তারিখের টিকিট চাই।

যা কি না কোনও ভাবে মনে রেখে কাউন্টারের সামনে বলতে পারলেই হল। তাতেই হাতে ‘বাবু’ বা ‘দাদা’দের গুঁজে দেওয়া টাকায় আসবে রোহিতদের দেখার টিকিট। তার জন্য মিলবে কমিশনও। শহরের বুকে আইপিএল-কে কেন্দ্র করে টিকিটের বিক্রির এমন ছবি দেখতে মঙ্গলবার পৌঁছনো গিয়েছিল রেড রোডের ধারের মাঠে। যেখানে আইপিএলের বোর্ড লাগানো তিনটি অনলাইন কাউন্টারের পাশাপাশি রয়েছে সবুজ টিন ঘেরা ছোট ছোট ঘর। সেই ঘরের খুপরি জানলার সামনেই পুরুষ ও মহিলাদের লম্বা লাইন।

Advertisement

ইডেন গার্ডেন্সের সামনে থেকে মহমেডান স্পোর্টিংকে ডান হাতে রেখে মেঠো রাস্তা ধরে এগোতেই দেখা গেল, গাছের ছায়ায় বসে রয়েছেন কালো গেঞ্জি, হাফ প্যান্ট পরা এক ব্যক্তি। তাঁর সামনে হন্তদন্ত হয়ে এসে এক যুবক বললেন, ‘‘আমি তো তোমার নিজের লোক। আমার থেকে তো ৫০ টাকা কম নিতে পার।’’ আরও কয়েক পা যেতে মাঠে বসা এক যুবককে নিচু গলায় বলতে শোনা গেল, ‘৮০০, ৮০০। লাগবে নাকি দাদা? একটু পরে আর পাবেন না। সব ব্ল্যাক হচ্ছে।’’

‘এত দাম দিয়ে নেব না’ বলে আরও একটু এগোতেই চোখে পড়ল সেই লম্বা লাইন। যেখানে কেউ ছাতা মাথায়, কেউ আবার শাড়ি বা ওড়নার আঁচল দিয়ে রোদ আড়াল করে মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন কাউন্টারের সামনে যেতে। ‘লাইনটা কিসের?’ শাড়ির আঁচল না সরিয়েই উত্তর এল, ‘টিকিটের।’

‘আপনারা খেলা দেখবেন?’ শুকনো মুখগুলো চুপ। ফের একই প্রশ্ন করতে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন ডায়মন্ড হারবারের বাসিন্দা মাজিদা বিবি। বললেন, ‘‘দেখব তো। টিকিট পাই কি না আগে দেখি।’’ কিন্তু কোন দলের খেলা, কে কে খেলছে প্রশ্ন করতেই মুখ ঘুরিয়ে নিলেন মাজিদা-রা। ভোর থেকে এক ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে লাইনেই বসে পড়া এক বৃদ্ধা বললেন, ‘‘অত বলতে পারব না। লাইনে কথা বলা বারণ।’’

‘বারণ’-এর কারণ অবশ্য চোখে পড়ল। লাইনের পাশেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন কয়েক জন যুবক ও প্রৌঢ়। পুলিশের হাতে ধরা পড়ার ভয়ে তাঁরা নিজেরা লাইনে দাঁড়াচ্ছেন না। বদলে মাঝেমধ্যে ফিসফিস করে কিছু কথা বলে নিচ্ছেন ওই লাইনে দাঁড়ানো মহিলা-পুরুষদের সঙ্গে। কেউ কাউন্টারের সামনে থেকে বেরিয়ে হনহন করে হেঁটে চলে যাচ্ছেন বেশ কিছুটা দূরে। পিছনে যাচ্ছেন আশপাশে ঘোরা যুবকের কেউ। গাছের ছায়ায় হাত বদল হচ্ছে ‘কাগজ’। যার একটা টিকিট, আর একটা নোট।

বিকেল ৪টে বাজতেই লাঠি উঁচিয়ে এল ঘোড়সওয়ার পুলিশ। মুহূর্তে ছত্রভঙ্গ লম্বা লাইন। জানা গেল, কাউন্টার বন্ধ হয়ে গিয়েছে। রেড রোড ছেড়ে তখন ধর্মতলার দিকে চলেছেন মাজিদা, কালাম, আনসারিরা। ‘কত পান টিকিট কেটে দিয়ে?’ ওঁরা জানালেন, একটা ৫০০ টাকার টিকিট কেটে কমিশন মেলে ১৫০-২০০ টাকা। কালাম বললেন, ‘‘নিউ মার্কেটে ২৫০ টাকা রোজে কাজ করি। এখানে দালালদের টিকিট কেটে দিলেই ৩০০-৪০০ টাকা রোজগার। গ্রামের মেয়েদের নিয়ে আসি। ওঁদেরও রোজগার হয়।’’

রেড রোডের উল্টো দিকের মাঠে ক্রাচ রেখে জিরিয়ে নিচ্ছিলেন শ্যামলী দলুই। বললেন, ‘‘সকাল ৬টায় লাইন দিয়েছি। আজ একটা টিকিট কেটেছি। ১৫০ টাকা পেয়েছি। ভিক্ষে করে তো এত পাই না।’’ টিকিট কাউন্টারের সামনে তখন টহল দিচ্ছে পুলিশ। টিকিটের খোঁজে তখন ভিড় জমছে বরফ জল, আইসক্রিম বিক্রেতার সামনে। মলিন প্যান্ট, খোঁচা দাড়ির এক প্রৌঢ়কে ফোনে বলতে শোনা গেল, ‘‘হ্যাঁ, ২৮ তারিখের আছে। ১২০০ লাগবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন