স্মরণ: মর্ডিকাই-এর সমাধিতে বাংলা ফলক। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
গোড়ায় শুধু হিব্রু লেখা হতো। পরে ইংরেজিও লেখা হয়েছে।
দু’বছর আগে মর্ডিকাই কোহেনের মৃত্যুর পরে সমাধিফলকে বাংলাও লিখতে চাইলেন তাঁর স্ত্রী জো। ‘‘বাংলা ভাষা, গান যে লোকটার প্রাণ ছিল।’’ সিমেন্টে বাঁধানো সমাধিতে তা-ও লেখা এখন। বাংলা বর্ণমালার প্রথম অনুপ্রবেশ কলকাতার ইহুদিদের সমাধিক্ষেত্রে। একদা ঢাকা টেলিভিশনের বাংলা সংবাদপাঠক-ঘোষক কোহেন সাহেবের শেষ ইচ্ছে ছিল, বাপ-ঠাকুরদার স্মৃতি জড়ানো সমাধিক্ষেত্রটির সংস্কার করে যাবেন।
তখনও জঙ্গলে ছাওয়া ওই তল্লাট। সিমেন্ট ক্ষয়ে ভেঙে যাচ্ছে সুদৃশ্য সব সমাধিসৌধ। পাশের সরকারি আবাসনের জঞ্জাল উপচে পড়ে কবরখানার মাঠে। সন্ধে নামলে পাঁচিল টপকে ঢোকা নেশাখোরদের আড্ডা। মর্ডি কোহেনের অবর্তমানে তাঁর স্ত্রীর জোয়ের তত্ত্বাবধানেই সাবেক সমাধিক্ষেত্রের ক্রমশ ভোল পাল্টাচ্ছে।
নজরদারির জন্য সিসিটিভি বসিয়ে, পাঁচিলে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে চলছে ধূসর, শ্যাওলা জমা ভাঙাচোরা সমাধি বাঁধাইয়ের কাজ। কলকাতার ইহুদিরা এখন ২০-২২ জনে ঠেকেছেন। বিদেশের আত্মীয়-শুভানুধ্যায়ীদের অনুদানে শহরের ইহুদি স্মারকসৌধগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে তাঁরাই লড়ছেন।
ফুলবাগান মোড়ের কাছে নারকেলডাঙা মেন রোডের সমাধিক্ষেত্রে মেরামতি-চুনকামের কাজ চলতে চলতেই উঠে আসছে ইতিহাসের অমূল্য সম্পদ। ১৭৯৮-এ সিরিয়ার আলেপ্পো থেকে আসা জহুরি শালোম কোহেনই কলকাতার ইহুদি সমাজের প্রতিষ্ঠাতা। হিব্রুতে লেখা তাঁর সমাধি ইংরেজি হরফে চিহ্নিত করা হয়েছে। কয়েক হাজার কবরের ক্ষয়ে যাওয়া ফলক ঘেঁটে ১৮১২ সালের প্রথম সমাধিটি খুঁজে পাওয়া অবশ্য মুশকিল। তবে বড়বাজারের চোখ ধাঁধানো মাঘেন ডেভিড সিনাগগ এবং জিউয়িশ বয়েজ ও গার্লস স্কুলের রূপকার এলিয়াস মোজেস কোহেনের সমাধিটি সাফসুতরো হয়েছে। ইহুদি ধর্মের বিশিষ্ট স্মারক, একটি গেনিজাও রয়েছে সেখানে। ধর্মগ্রন্থ বা ঈশ্বরের নাম লেখা মৃতজনের কাগজপত্র-দলিল—গেনিজায় জমা করাই দস্তুর।
কিছুটা হাল আমলের স্মৃতি সলোমন ও ডেভিড নাহুমও শায়িত এই চত্বরেই। কলকাতাকে ইহুদিদের স্মরণীয় উপহার নিউ মার্কেটের কেক-বিপণির তাঁরা দুই কর্তা। কলকাতার ইহুদিরা চান, সমাধিক্ষেত্রটির দেওয়ালও রং করে ভিতরের পুকুর ঘেরা ফাঁকা অংশটি পার্কের মতো সাজাতে। কেউ মারা গেলে ধর্মীয় আচার মেনে স্নান করিয়ে তাঁর দেহ সমাধিস্থ করার কাজ সারতেও এখন মুম্বই অথবা বেঙ্গালুরু থেকে কোনও অভিজ্ঞ ইহুদিকে কলকাতায় ডেকে আনতে হয়। সমাধি ক্ষেত্রে ধর্মীয় প্রতীক ডেভিডের স্টার-চিহ্নিত প্রার্থনাঘর থাকলেও প্রার্থনা করার লোকের অভাব। তবু কলকাতার ইতিহাস-গবেষক বা মৃতদের কলকাতাছাড়া প্রিয়জনেরা আসতে পারেন! তাই সমাধিক্ষেত্রটি রক্ষা করতে চান জো কোহেন।
শহরে ইহুদিদের কমিউনিটি অ্যাফেয়ার্স-এর সচিব বৃদ্ধা একা কুম্ভের মতো ঘুরে যান, রক্ষী-ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। ম্লান হেসে বলেন, ‘‘ইজরায়েল-আমেরিকায় ছেলেমেয়েরা বলছে, তাদের কাছে গিয়ে থাকতে! কিন্তু এই তো ক’জনে আছি আমরা, যত দিন পারি, কমিউনিটির স্মৃতি রক্ষার কাজ করে যাব!’’