এ বার বিতর্কে নজরুলের ‘ধূমকেতু’!

যে বাড়ি সম্পর্কে লেখক ‘কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা’ বইটিতে বলেছেন, ৭এ এবং ৭বি প্রতাপ চ্যাটার্জি লেনের সেই বাড়ি, সেই সিঁড়ি এখনও রয়েছে একই ভাবে।

Advertisement

দেবাশিস ঘড়াই

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৯ ০৩:১০
Share:

উদাসীন: জরাজীর্ণ বাড়িটি। সেই সিঁড়ি। ছবি: রণজিৎ নন্দী

‘কিছুক্ষণের মধ্যেই দোতলায় ওঠার সিঁড়িতে একসঙ্গে অনেকগুলি জুতোর শব্দ শোনা গেল। পুলিশ এসেছে ‘ধূমকেতু’ আফিসে তালাশির পরওয়ানা ও কাজী নজরুল ইস‌্লামের নামে গিরেফ‌্‌তারী পরওয়ানা নিয়ে। নজরুল তখন সমস্তিপুরে গিয়েছিল বলে গিরেফ‌্‌তার হয়নি।’। লেখাটি কমিউনিস্ট আন্দোলনের পুরোধা প্রয়াত মুজফ‌্‌ফর আহমেদের, যিনি কাজী নজরুল ইসলামের দীর্ঘদিনের সঙ্গী ছিলেন।

Advertisement

যে বাড়ি সম্পর্কে লেখক ‘কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা’ বইটিতে বলেছেন, ৭এ এবং ৭বি প্রতাপ চ্যাটার্জি লেনের সেই বাড়ি, সেই সিঁড়ি এখনও রয়েছে একই ভাবে। লেখক আরও লিখছেন, ‘৭ নম্বর প্রতাপ চাটুজ্যে লেনের দোতলায় তিনটি খুব বড় বড় ঘর। রান্না ঘরও ছিল।’ সেই ঘরগুলিও রয়েছে। শুধু পাল্টে গিয়েছে আবহ। আর সেই পরিবর্তিত আবহের মধ্যেই ওই বাড়িটি নিয়ে আপাতত বিতর্ক শুরু হয়েছে।

বিতর্ক কারণ, একপক্ষের বক্তব্য, বাড়িটি ঘিরে নজরুলের যে স্মৃতি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে, যে বাড়ি থেকে নজরুল ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার বেশ কয়েকটি সংখ্যা প্রকাশ করেছিলেন, সেই বাড়িটির সংরক্ষণে সরকারি তরফে যথাযথ ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। বর্তমানে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ওই বাড়ি প্রায় ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়েছে। আবার বাড়িটির মালিকপক্ষের বক্তব্য, ওই বাড়িটির সঙ্গে যে নজরুলের স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে, এমন প্রামাণ্য কোনও তথ্য তাঁদের হাতে নেই। শুধু তাই নয়, ওই বাড়িটি যে হেরিটেজ, তা জানা গিয়েছে বাড়িটি কেনার পরে!

Advertisement

বর্তমানে বাড়িটিতে কয়েক জন ভাড়াটে থাকেন। নীচে রয়েছে একটি কারখানা। ভগ্নপ্রায় সিঁড়ি ধরে উপরে উঠে গেলে দেখা যাবে, নজরুলের স্মৃতিকথায় বাড়িটি সম্পর্কে যা যা উল্লেখ করা হয়েছে, তার ছাপ এখনও স্পষ্ট সেখানে। বাড়ির এক জন ভাড়াটে কৌশিক পাল বলেন, ‘‘এখানে যে নজরুল থাকতেন, তার একাধিক প্রমাণ রয়েছে। আমরা একাধিক বার নজরুলের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য পুরসভা, রাজ্য সরকার-সহ সব জায়গায় চিঠি দিয়েছি। কিন্তু কোনও জায়গা থেকেই সাড়া পাইনি।’’ অন্য এক ভাড়াটে মন্মথ প্রধান বলেন, ‘‘ঐতিহাসিক গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে এই বাড়িটি সরকারের অধিগ্রহণ, সংস্কার ও সংরক্ষণ করা উচিত।’’

ইতিহাসের একটি সূত্র বলছে, প্রথমে ‘ধূমকেতু’ পত্রিকাটি ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিট থেকে বার হলেও পরবর্তীকালে সেটি প্রতাপ চ্যাটার্জি লেনের ওই বাড়িটি থেকেই প্রকাশিত হয়। শুধু পত্রিকা প্রকাশই নয়, নজরুল ওখানে থাকতেনও। এমনকি, নজরুলের জীবনের কারাবাসের ঘটনার সঙ্গেও ওই বাড়ির নিবিড় যোগ রয়েছে। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক সুস্নাত দাশ জানাচ্ছেন, ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ শীর্ষক কবিতাটি ধূমকেতুর একটি সংখ্যায় প্রকাশিত হওয়ার পরেই তা ব্রিটিশরাজের রোষানলে পড়ে। কারণ, ওই লেখাকে শাসক-বিরোধী বলা হয়েছিল। নজরুলের নামে গ্রেফতারি পরওয়ানাও জারি হয়েছিল। সুস্নাতবাবুর কথায়, ‘‘কলকাতায় নজরুলের স্মৃতির সঙ্গে ওই বাড়িটি ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে। ফলে বাড়িটি যদি সংরক্ষণ করা যায় বা গ্রন্থাগার করা যায়, সেটাই আমাদের কাম্য।’’

বর্তমান বাড়ির মালিক আবু সৈয়দও চাইছেন যে, বাড়িটির সঙ্গে যদি নজরুলের স্মৃতি জড়িয়ে থাকে, তা হলে তার সংরক্ষণ করা হোক। যদিও তাঁর বক্তব্য, ‘‘যখন বাড়িটি কিনেছিলাম, তখন কোথাও বাড়িটি হেরিটেজ, তেমন উল্লেখ ছিল না। সেটা জানলে তো বাড়িটি কিনতামই না। কারণ, গত পাঁচ বছর ধরে পুরসভায় এটা নিয়ে দৌড়চ্ছি। রীতিমতো হেনস্থার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। হঠাৎ কী করে বাড়িটি হেরিটেজ তালিকার ‘গ্রেড পেন্ডিং’ তালিকায় উঠে গেল, বুঝতে পারলাম না!’’ প্রশাসন সূত্রের খবর, এই বিতর্কের মধ্যেই পুরসভার হেরিটেজ কমিটির একটি দল বাড়িটি পরিদর্শন করে। ওই দলের এক সদস্যের কথায়, ‘‘বাড়িটি পরিদর্শন করা হয়েছে। এখন দেখা যাক কী করা যায়।’’

ধূমকেতুর উদ্দেশ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘আয় চলে আয়, রে ধূমকেতু, আঁধারে বাঁধ্ অগ্নিসেতু...’। কিন্তু আঁধারে অগ্নিসেতু বাঁধার দায়িত্ব যাকে নিতে বলা হয়েছিল, এত বিতর্কের মধ্যে সেই ‘ধূমকেতু’-র অফিসের ভবিষ্যৎই এখন অন্ধকারে কি না, প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন