পার্বণী মেজাজে পথে নামল ঢল

বিকেল পাঁচটা পার্ক স্ট্রিট মো়ড়ে দাঁড়ানো ট্র্যাফিক সার্জেন্ট মোবাইল ফোনে বলছিলেন, ভিড় রাস্তায় নেমে প়ড়েছে। ব্যস শীতের উৎসব শুরু হয়ে গেল! সন্ধ্যা যত গড়িয়েছে ততই ভিড় বেড়েছে পার্ক স্ট্রিট চত্বরে।

Advertisement

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০১৭ ০১:৩২
Share:

নিয়ন্ত্রণ: তখন সবে সন্ধ্যা। বড়দিনের পার্ক স্ট্রিটে ভিড়ের চাপ সামলাতে পথে নেমে পড়েছে পুলিশ। রবিবার। ছবি: সুমন বল্লভ

ছুটির দিনে ভরদুপুরে ক্যানিং স্ট্রিটে গিয়ে তাজ্জব বনে গিয়েছিলেন বছর চল্লিশের ঋক ঘোষ। রবিবার ওই রাস্তা সুনসান থাকাই দস্তুর। এ দিন সেখানে কেক, ক্রিসমাস ট্রি, সান্তা টুপির মেলা বসে গিয়েছে!

Advertisement

বিকেল পাঁচটা পার্ক স্ট্রিট মো়ড়ে দাঁড়ানো ট্র্যাফিক সার্জেন্ট মোবাইল ফোনে বলছিলেন, ভিড় রাস্তায় নেমে প়ড়েছে। ব্যস শীতের উৎসব শুরু হয়ে গেল! সন্ধ্যা যত গড়িয়েছে ততই ভিড় বেড়েছে পার্ক স্ট্রিট চত্বরে।

একে ক্রিসমাস ইভ, তার উপরে ছুটির দিন। সব মিলিয়ে রবিবার সকাল থেকেই শহরে ছিল উৎসবের উষ্ণ মেজাজ।

Advertisement

উষ্ণই বটে! আলিপুর হাওয়া অফিস বলছে, এ দিন কলকাতার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ১৫.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, স্বাভাবিকের থেকে ১ ডিগ্রি বেশি। বড়দিনের আবহে যা অনেকটাই বেমানান। আজ, সোমবার বড়দিনেও কলকাতায় জাঁকিয়ে শীত পড়ার সম্ভাবনা কম।

আবহাওয়ার এই খামখেয়ালিপনাকে অবশ্য তুড়ি মে়ড়ে ওড়াচ্ছে কলকাতা। যার সব থেকে ভাল উদাহরণ এ দিনের চিড়িয়াখানার ভিড়। সকাল সাড়ে আটটায় টিকিট কাউন্টার খোলার আগেই লম্বা লোকের লাইন। বেলা গড়ানোর তালে তালে উপচে পড়েছে ভিড়। সেই ভিড় এবং গাড়ির চাপ সামলাতে হিমসিম খেয়েছে পুলিশ। চিড়িয়াখানার অধিকর্তা আশিসকুমার সামন্ত সন্ধ্যায় জানান, এ দিন ৯৭ হাজার টিকিট বিক্রি করেছেন তাঁরা। এর আগে কোন ক্রিসমাস ইভে এমন ভিড় হয়েছে, তা মনে করতে পারছেন না চিড়িয়াখানার পুরনো কর্মীরাও। তাঁরা দেখছেন, সম্প্রতি প্রকাশ্যে আসা সিংহ, জাগুয়ার, ক্যাঙারুর খাঁচার সামনেই বেশি ভি়ড়। আর পুরনো তারকা হিসেবে শিম্পাঞ্জি, হাতি, বাঘেরা তো ছিলই। বিকেল সোয়া পাঁচটায় লালবাজার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল জানাল, চি়ড়িয়াখানার ভিড়ে ওই এলাকায় গাড়ি ঢিমেতালে চলছে।

প্রহরা: ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল-এ কড়া নজরদারি। —নিজস্ব চিত্র।

দুপুরে উপচোনো ভিড় ভিক্টোরিয়া, ময়দান চত্বরেও। সেই ভি়ড়েই মিশে ছিলেন রুকসানা ও আবির। ফেসবুকে আলাপের পরে ‘ডেট’ করতে বেছে নিয়েছিলেন ক্রিসমাস ইভটাই। ভিক্টোরিয়াকে পিছনে রেখে দু’জনে সেলফি তুলেছেন, তার পরে পা়ড়ি দিয়েছেন গঙ্গার দিকে। কিন্তু কোথায় কী! প্রিন্সেপ ঘাট, মিলেনিয়াম পার্কেও থিকথিকে ভিড়। শেষমেষ নিভৃতি খুঁজতে বিকেলের চক্ররেলই ভরসা ডে়টিং জুটির।

ময়দানে অনেকেই মাটিতে চাদর বিছিয়ে পিকনিকে মজেছেন। পড়ন্ত বিকেলে গ়ড়ের মাঠে খুদেদের ছুটোছুটিতে উড়েছে ধুলো। ভিড়ের মাঝে কোনও আপত্তিকর ঘটনা আটকাতে ওই সব এলাকা কড়া নজরে রেখেছিল পুলিশ। কোথাও কোনও বেচাল দেখলেই জুটেছে উর্দিধারীদের ধমক।

চিড়িয়াখানা, ময়দান, ভিক্টোরিয়ার চেনা পরিসর ছেড়ে এ বার বেশ কিছু ভিড় জুটেছে বড়বাজারের ব্রেবোর্ন রোড, পোলক স্ট্রিটেও। সম্প্রতি ওই দুই এলাকায় দু’টি সাবেক সিনাগগের (ইহুদি উপাসন) সংস্কার করে কার্যত নবজন্ম ঘটেছে। চোখ ধাঁধানো অভিজাত স্থাপত্য দেখতে দেশ-বিদেশ থেকে কলকাতাপ্রেমী অনেকেই সেখানে হাজির হচ্ছেন। এ দিন ওই দুই সিনাগগে দেখা মিলল শিলচরের শামিম আহমেদ লস্কর, তানিয়া এবং চট্টগ্রামের রকিবুল কামাল ও ফারহানা আনন্দময়ীর। এসেছিলেন দিল্লি, বেঙ্গালুরুর কয়েক জন প্রবাসী বাঙালিও। ফারহানা বলছেন, ‘‘শহরের মধ্যে এমন স্থাপত্যও যে আছে, তা জানতাম না। সম্প্রতি এক বন্ধুর কাছ থেকে সংস্কারের গল্প শুনে ঠিক করে ফেলি, কলকাতায় গেলে সিনাগগ দেখতেই হবে।’’

দুপুরের ভিড় যদি বা ভিন্ন পথে চলে, সন্ধ্যায় কিন্তু কলকাতা ফিরে গেল সাবেক ছন্দেই। বো ব্যারাকের আলো ঝলমলে রাস্তা ছিল স্বমহিমায়। ছিল শখের ফোটোগ্রাফারদের ভিড়। দমদম থেকে মেট্রোযাত্রীদের বেশির ভাগই নেমেছেন পার্ক স্ট্রিটে। তার পরে সোজা পথিমধ্যে সান্তা টুপি, আলোজ্বলা শিং কিনে সোজা অ্যালেন পার্কে। গত ক’বছর ধরেই পার্ক স্ট্রিটতে বড়দিন ও বর্ষশেষে পার্ক স্ট্রিটকে উৎসবের চেহারা দিয়েছে রাজ্য সরকার। অ্যালেন পার্ককে কেন্দ্র করে বসছে বড়দিনের মেলা। বচ্ছরকার উৎসবে সেজে ওঠা সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালেও ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে মানুষের ঢল।

সেন্ট পল্স ক্যাথিড্রালে কড়া নজরদারি। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।

বাঙালি জানে, কলকাতা উৎসবের শহর। দুর্গাপুজো হোক কিংবা ব়ড়দিন, রাস্তায় ভিড় জমবেই। তাই অতিরিক্ত সতর্ক পুলিশ। লালবাজার সূত্রের খবর, এ দিন রাস্তায় অতিরিক্ত দে়ড় হাজার পুলিশকর্মী নামানো হয়েছে। দুপুর থেকে রাত, ঘুরেঘুরে নজরদারি করেছেন উচ্চপদস্থ কর্তারাও। শহরের নানা প্রান্তে ওয়াচ টাওয়ার, টহলদারি ভ্যান, সাদা পোশাকের গোয়েন্দারাও হাজির। কন্ট্রোল রুমে বসে চলেছে সিসিটিভি-র নজরদারিও। এ দিন দুপুরে ভিক্টোরিয়ার সামনে দেখা গিয়েছে, উন্নত মানের স্বয়ংক্রিয় রাইফেল নিয়ে মাঝেমধ্যেই পায়চারি করছেন স্পেশ্যাল ফোর্সের জওয়ানেরা। পুলিশ সূত্রের খবর, ভিড় জমজমাট উৎসবকেই নিশানা করতে পারে সন্ত্রাসবাদীরা। সম্প্রতি এ রাজ্যে হদিস মিলেছে বাংলাদেশি জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লা বাংলা টিমের ঘাঁটির। কয়েক জন গ্রেফতার
হলেও অনেকেই পুলিশের নাগালের বাইরে রয়েছে। তাই এ বছর সতর্কতা আরও বেশি।

রাত যত গড়িয়েছে ততই জমেছে বড়দিনের মেজাজ। পার্ক স্ট্রিটের রেস্তোরাঁগুলির টেবিলে টেবিলে পানাহার, খোশগল্পের উষ্ণতা। কেউ বা ইষৎ টলোমলো পায়ে বাড়ির পথ ধরছেন। রাত ১০টাতেও সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালে জমজমাট ভিড়। সাজানো বাগানে চলছে সেলফি-র হুজুগ। ভিড়ের পাশাপাশি ‘ভিআইপি’-র আগমন বার্তা পেয়ে তটস্থ পুলিশও।

এ ভাবেই রাত বয়ে গেল। ঘড়িতে বারোটা বাজতেই গির্জায় গির্জায় শুরু হল ক্যারল।

ঈশ্বরপুত্রের আবাহনে শুরু হল বড়দিন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন