ছদ্মবেশী বাজিতে কাত কলকাতা

স্থানীয় থানায় ফোন করে সুরাহা মিলল না। শেষমেশ লালবাজার কন্ট্রোল রুমকে জানানোয় তাঁরা টহলদারি ভ্যান পাঠানোর পরে কিছুক্ষণ কমল শব্দের ত্রাস। পুলিশ চলে যাওয়া মাত্র শব্দদৈত্য ফিরল স্বমহিমায়। রাত ১টা পর্যন্ত।

Advertisement

সুরবেক বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০১৭ ০১:৫৫
Share:

আকাশ ফুঁড়ে: এই আতসবাজিগুলি যখন উড়ে গিয়ে আলো ছড়াচ্ছে, তুমুল শব্দে কেঁপে উঠছে চারপাশ। শুক্রবার, দক্ষিণ কলকাতার আকাশে। —নিজস্ব চিত্র।

কানের সমস্যার জন্য তিন দিন আগেই ডাক্তার দেখিয়ে এসেছেন। ইএনটি বিশেষজ্ঞ বলেছেন, টানা চিকিৎসার দরকার, জোরে শব্দ শোনা নিষেধ। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাত সওয়া ১১টায় ফ্ল্যাটের গা ঘেঁষে বিকট শব্দে শেল ফাটার পরে নেতাজিনগরের ওই বৃদ্ধা ভাবলেন, তাঁর ডান কানটার বুঝি স্থায়ী বারোটা বাজল। টানা ফেটেই চলেছে শব্দবাজি।

Advertisement

স্থানীয় থানায় ফোন করে সুরাহা মিলল না। শেষমেশ লালবাজার কন্ট্রোল রুমকে জানানোয় তাঁরা টহলদারি ভ্যান পাঠানোর পরে কিছুক্ষণ কমল শব্দের ত্রাস। পুলিশ চলে যাওয়া মাত্র শব্দদৈত্য ফিরল স্বমহিমায়। রাত ১টা পর্যন্ত।

কেবল রানিকুঠির কাছে ওই তল্লাট নয়, এ বছর বিরাটি থেকে বিজয়গড়, বারাসত থেকে বাঁশদ্রোণী, শহরের সর্বত্র মোটামুটি এটাই চিত্র। রাত ১১টার পরেই শব্দবাজি প্রবল ফাটতে শুরু করেছে শহরের অধিকাংশ জায়গায়। বৃষ্টি থামার পরেই।

Advertisement

সুপ্রিম কোর্ট দিল্লিতে এ বার দীপাবলিতে সব রকম বাজি নিষিদ্ধ করেছে। তার পরে পশ্চিমবঙ্গ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ও পরিবেশকর্মীদের একাংশ ভেবেছিলেন, শব্দবাজি এই রাজ্যে এমনিতেই নিষিদ্ধ, এ বার অন্যান্য বাজিও কম পুড়বে। দীপাবলির সন্ধ্যা দেখিয়ে দিল, তাঁরা বড্ড বেশি আশাবাদী ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন।

লালবাজার জানাচ্ছে, বৃহস্পতিবার রাতে বেআইনি শব্দবাজি ফাটানোর অভিযোগে পুলি‌শ ৩৬৯ জনকে গ্রেফতার করেছে, আটক করা হয়েছে ৭৬২ কেজি ৭০ গ্রাম শব্দবাজি।

পর্ষদের চেয়ারম্যান কল্যাণ রুদ্র জানাচ্ছেন, তাঁর বাড়ির কাছে বাঙুর-লেক টাউনে শব্দবাজি ফেটেছে দেদার। কল্যাণবাবু জানান, দীপাবলির রাতে সল্টলেকে পর্ষদের কন্ট্রোল রুমে ৪০টি অভিযোগ জমা পড়েছে, যা অন্যান্য বারের চেয়ে বেশি। লালবাজার কন্ট্রোল রুমে আসা অভিযোগের সংখ্যা শ’দেড়েক। পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘সবুজ মঞ্চ’-র নব দত্ত জানাচ্ছেন, তাঁরা অভিযোগ পেয়েছেন ৩০টি। রেহাই পায়নি হাসপাতাল অর্থাৎ, সাইলেন্স জোন-ও।

পর্ষদের অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য আইন আধিকারিক, বর্তমানে পরিবেশকর্মী বি‌শ্বজিৎ মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ৫ মে পর্ষদ বিজ্ঞপ্তি জারি করে জানায়, এই রাজ্যে শব্দবাজি তৈরি ও মজুত করা যাবে ভিন্‌ রাজ্যে পাঠানোর শর্তে। ফলে শব্দবাজি তৈরির ভরা মরসুম অর্থাৎ, গ্রীষ্মকালে আঁতুড়ঘরে হানা দেয়নি পুলিশ।

কিন্তু বিশ্বজিৎবাবুর মতে, কোনও বাজি উৎপাদক ভিন্ রাজ্যে শব্দবাজি পাঠানোর বরাত পেয়েছেন, এমন কাগজ দেখার পরেই তাঁকে শব্দবাজি তৈরির অনুমতি দিতে পারত পর্ষদ। পুলিশ সেই বাজি পাহারা দিয়ে রাজ্যের সীমানা পার করে দিতে পারত। এর খরচ বহন করত সেই কারখানা। বাকি উৎপাদকদের ঘরে পুলিশ হানা দিলে তখনই শব্দবাজিকে জব্দ করা যেত। কিন্তু এমনটা হয়নি। পর্ষদের কর্তারাও মানছেন, তাঁদের বিজ্ঞপ্তি অনুসারে এই রাজ্যে শব্দবাজি তৈরি হয়েছে, তবে তার বড় অংশ অন্য রাজ্যে না গিয়ে এই রাজ্যেই বিক্রি হয়েছে ও ফেটেছে।

সেই সঙ্গে তামিলনাড়ুর শিবকাশী থেকে আসা আলোর বাজির ছদ্মবেশে থাকা শব্দবাজি তো ছিলই। বহু ক্রেতা বোকা বনে গিয়েছেন সে সব কিনে। তাঁদের বলা হয়েছে, সামান্য শব্দ করে সেগুলো আকাশে আলোর মালা তৈরি করবে। অথচ আলোর ঝলকানি তৈরির আগে চকলেট বোমা, দোদোমার চেয়ে অনেক জোরে ফেটেছে সে সব। দশ বছর আগে রাজ্য পরিবেশ দফতর তামিলনাড়ুর বাজি প্রস্তুতকারকদের অ্যাসোসিয়েশন-কে চিঠি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে কোনও রকম শব্দবাজি পাঠাতে নিষেধ করেছিল। কিন্তু তার পরেও শিবকাশী থেকে নিয়মিত ঢুকছে শব্দবাজি।

মানবদেহে শব্দবাজির কী কুফল হয়, সেটা খতিয়ে দেখতে জাতীয় পরিবেশ আদালতের নির্দেশে গড়া পর্ষদের কমিটির প্রধান, ইএনটি বিশেষজ্ঞ দুলাল বসুর দাবি, ‘‘এ বার কিছু তল্লাটে শব্দবাজি বেশি, কিছু তল্লাটে কম। এটাই আশার দিক।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন