১৭৫ পেরিয়েও ওদের টগবগানি থামেনি

কলকাতা পুলিশের তথ্য বলছে, মহানগরের এই বাহিনী বয়সে কলকাতা পুলিশের থেকেও বড়। ১৮৪০ সালে দু’জন সওয়ার এবং এক জন দফাদার (মুখ্য আধিকারিক)-কে নিয়ে তৈরি হয় ঘোড়সওয়ার বাহিনী।

Advertisement

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০১৮ ০৩:১৬
Share:

লাগাম হাতে: শহরের পথে ঘোড়ায় সওয়ার বাহিনী। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

রূপমতীর পিঠের ‘কদর’-ই আলাদা। শোনা যায়, তার পিঠে চেপেছিলেন খোদ রাই বিনোদিনী ঐশ্বর্যা! প্রীতিলতাই বা কম যায় কী সে! তার পিঠেও উঠেছিলেন টলিউডের সুপারস্টার।

Advertisement

রূপমতী, প্রীতিলতারা আসলে কলকাতা মাউন্টেড পুলিশের ঘোড়া। যাদের পিঠে চেপে ময়দান এলাকায় টহল দেন উর্দিধারীরা। গড়ের মাঠে বিশৃঙ্খল জনতাও এই বাহিনীকে দেখলে সুবোধ বালক হয়ে ওঠে।

কলকাতা পুলিশের তথ্য বলছে, মহানগরের এই বাহিনী বয়সে কলকাতা পুলিশের থেকেও বড়। ১৮৪০ সালে দু’জন সওয়ার এবং এক জন দফাদার (মুখ্য আধিকারিক)-কে নিয়ে তৈরি হয় ঘোড়সওয়ার বাহিনী। সে সময়ে তাঁদের কাজ ছিল সরকারি বার্তা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পৌঁছে দেওয়া এবং কোনও জাহাজ দেখতে পেলে হারবার মাস্টারকে তা জানানো। ১৮৪২ সালে ময়দান এলাকায় টহলদারির দায়িত্ব পায় ঘোড়সওয়ার বাহিনী। এত পুরনো বাহিনীর অন্দরে অন্দরে লুকিয়ে আছে নানা ঘটনা, গল্প, ইতিহাস।

Advertisement

তারই অঙ্গ রূপমতী, প্রীতিলতাদের পিঠে তারকাদের চাপার ঘটনাও। পুলিশ সূত্রের খবর, অনেক সময়ে সিনেমার প্রয়োজনে ঘোড়ায় চড়ার প্রশিক্ষণ দিতে ওদের ব্যবহার করা হয়। চোখের বালি সিনেমার জন্য ঐশ্বর্যা, চাঁদের পাহাড়ে দেব কিংবা ব্যোমকেশের চরিত্রের জন্য আবির চট্টোপাধ্যায় চেপেছিলেন ওদের পিঠে।

তবে আরও অনেক ঘটনাও রয়েছে। সূত্রের খবর, ১৯০৫ সালের আগে মূলত ভারতীয়রাই সওয়ারের চাকরি করতেন। পরে গোরা পুলিশও এর পিঠে চাপতে শুরু করে। তাদেরই এক জন ছিলেন কলকাতা পুলিশের প্রবাদপ্রতিম চরিত্র রনি মুর। প্রবীণ লোকেরা এখনও বলেন, ঘোড়ায় চেপে রনি মুর ময়দানে টহল দিতে ঢুকলে সব গোলমেলে জনতা চুপসে যেত! আবার পুলিশকে শায়েস্তা করতে ঘোড়ার গায়ে সিগারেটের ছ্যাঁকার মতো অসভ্যতাও ছিল সে সময়ের ময়দানে গোলমালের অঙ্গ।

পুলিশের অনেকে অবশ্য বলেন, শুধু মানুষ দিয়ে এই বাহিনীকে বিচার করা কঠিন। বর্তমানে যে ৬৭টি ঘো়ড়া রয়েছে, তাদেরও অবদান কিন্তু কম নয়। তাই মানুষের চেয়ে তাদের যত্নআত্তি কম হয় না। আবার রুটিন মেনে ডিউটিও করতে হয় এই চারপেয়েদের। এক সময়ে বিলেত থেকে ঘোড়া আসত কলকাতা পুলিশে। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে দিল্লি, হরিয়ানা, পুণের খামার থেকে ঘোড়া আসত। কলকাতা রেসকোর্সও দৌ়ড়ের কেরিয়ার শেষ হয়ে যাওয়া ঘোড়া উপহার দিয়েছে লালবাজারকে।

ভোরে সামান্য নাস্তার পরেই দিন শুরু হয়ে যায় ওদের। কাউকে পিঠে সওয়ারি চাপিয়ে বেরোতে হয় টহলদারিতে, কেউ আবার সহিসের সঙ্গে চলে যায় ‘প্যাডক’-এ কসরত করতে। ডিউটি, কসরত শেষে ফিরে আসে এস এন ব্যানার্জি রোডে বাহিনীর সদর দফতরের আস্তাবলে। শোনা যায়, ঘো়ড়া নাকি সারাক্ষণ দাঁড়িয়েই থাকে! ব্যাপারটা কিন্তু মোটেও তা নয়। আস্তাবলেই বিরাট এক বালির বিছানা করা রয়েছে ওদের জন্য। ডিউটি বা কসরত শেষে সেখানে ঘোড়াদের গড়াগড়ি দেখলে হেসে কুটোপাটি হতে হবে। আসলে ওই বালিতে গড়াগ়ড়ি দিয়ে ঘাম শুকিয়ে নেয় পুলিশ-ঘোড়ারা। তার পরে ছোলা, ভুসি আর ঘাসে পেটপুজো সেরে সামান্য জিরিয়ে নেওয়া। ফের রোস্টার মেনে ডিউটিতে বেরনো। নিয়মিত ওদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন ডাক্তার। ‘‘অত বড়, টানটান চেহারা দেখলেই লোকের সম্ভ্রম জাগে। কিন্তু আমরা জানি, ওরা কতটা বাধ্য,’’ সগর্বে বলছেন বহু দিন মাউন্টে়ড পুলিশে চাকরি করা এক অফিসার।

এই ডিউটি নিয়েও কত কথা শোনা যায় প্রাক্তন পুলিশকর্তাদের কাছে। এক সময়ে এই ঘো়ড়াই ছিল পুলিশের যাতায়াতের মূল বাহন। যানবাহন সামলানো বা আইনশৃঙ্খলা, ঘোড়ায় চেপেই উর্দিধারীরা ছুটে বেড়াতেন শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। সে সময়ে রাস্তার ধারে বিরাট বিরাট লোহার গামলা থাকত। তাতে থাকত টলটলে জল। ছুটতে ছুটতে ক্লান্ত ঘোড়ারা গলা ভেজাত সেখানেই। পরে অবশ্য ময়দানেই সীমাবদ্ধ হয় ঘোড়সওয়ার পুলিশের কাজ। কুচকাওয়াজ কিংবা গার্ড অব অনার দেওয়াতেও অপরিহার্য এই বাহিনী। দায়িত্ব বদলের সঙ্গে সঙ্গে বাতিল হয়ে যায় ঘোড়ার গামলাও। কয়েক বছর আগেও নাকি চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ের ফুটপাতে বাতিল হয়ে যাওয়া সেই গামলা দেখা যেত।

পুলিশের কর্তারা বলছেন, দায়িত্ব কমলেও কদর কমেনি মাউন্টেড পুলিশের। সকাল-বিকেল তাই এস এন ব্যানার্জি রোডের আস্তাবল থেকে খট-খট খুরের শব্দ পেলেই থমকে যায় যানবাহন। পথচলতি মানুষ দাঁড়িয়ে দেখেন, এ যুগের ‘চৈতক’-দের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন