জীবনদায়ী: গ্রিন করিডর ধরে ছুটছে অ্যাম্বুল্যান্স। ইনসেটে দিলচাঁদ সিংহ। ছবি: শৌভিক দে
শল্য চিকিৎসায় একটি মাইলফলক ছুঁয়ে ফেলল পূর্ব ভারত। সোমবার তিন রাজ্যের চিকিৎসকদের চেষ্টায় কলকাতায়, পূর্ব ভারতের মধ্যে এই প্রথম বার হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন হল। যদিও রোগী কেমন থাকবেন, সেটা জানতে আরও ৯৬ ঘণ্টা সময় কাটতে দিতে হবে বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা।
দীর্ঘদিন ধরেই শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা-সহ একাধিক সমস্যায় ভুগছিলেন ঝাড়খণ্ডের শিক্ষক, বছর চল্লিশের দিলচাঁদ সিংহ। চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, তাঁর হৃৎপিণ্ডের পেশি কাজ করছে না। হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন জরুরি।
এটা কয়েক মাস আগের ঘটনা। কিন্তু উপযুক্ত দাতা পাওয়া যাচ্ছিল না। শনিবার কলকাতায় আনন্দপুর এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন দিলচাঁদ। পরের দিন বেঙ্গালুরুর একটি বেসরকারি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, সেখানে ২১ বছর বয়সি এক যুবক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন। রবিবার সকালে তাঁর ‘ব্রেন ডেথ’ ঘোষণা করা হয়েছে। তাঁর হৃৎপিণ্ডই দিলচাঁদকে দেওয়া হবে। কলকাতার চিকিৎসকেরা হাসপাতালের চেন্নাই শাখার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। প্রতিস্থাপনের কাজে সহযোগিতার আশ্বাস দেয় রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরও।
সোমবার সকাল থেকে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় প্রস্তুতি শুরু হয়। চেন্নাইয়ের হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ কে আর বালাকৃষ্ণণ এবং কার্ডিয়াক অ্যানাস্থেটিস্ট সুরেশ রাও সকালে কলকাতায় চলে আসেন। চেন্নাইয়ের চিকিৎসকদের অন্য একটি দল বেঙ্গালুরু থেকে হৃৎপিণ্ড সংগ্রহ করে বিমানে ওঠেন। সতর্ক ছিলেন কলকাতা বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষও। বিমানের আট নম্বর সারিতে বাক্সবন্দি ওই হৃৎপিণ্ড কোলে নিয়ে বসেছিলেন হাসপাতালের প্রতিনিধিরা। নিয়ম অনুযায়ী, প্রথম সারির যাত্রীরা আগে নামেন। এ দিন তার ব্যতিক্রম ঘটিয়ে বিমানসেবিকারা জানিয়েছেন, এক চিকিৎসক-সহ হাসপাতালের ওই তিন প্রতিনিধি আগে নামবেন।
বিমানবন্দরের ওয়ান বি গেটের সামনে অ্যাম্বুল্যান্সটি দাঁড় করিয়ে রেখে দিয়েছিলেন আনন্দপুর হাসপাতালের কর্মীরা।
ঘড়ি ধরে
সকাল ৭টা ১০ মিনিট: বেঙ্গালুরুর এক বেসরকারি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসকেরা ‘ব্রেন ডেড’ রোগীর হৃৎপিণ্ড সংগ্রহ করেন।
সকাল ৮টা ৩৫ মিনিট: বিশেষ বাক্সে রাসায়নিকের মধ্যে হৃৎপিণ্ড নিয়ে রওনা দেয় বিমান।
সকাল ১১টা: কলকাতা বিমানবন্দরে নামল বিমান।
সকাল ১১টা ৯ মিনিট: হৃৎপিণ্ড নিয়ে বিমানবন্দর থেকে ‘গ্রিন করিডর’ ধরে আনন্দপুরের পথে ছুটল অ্যাম্বুল্যান্স।
সকাল ১১টা ২৯ মিনিট: আনন্দপুরের হাসপাতালে পৌঁছয় হৃৎপিণ্ড।
সকাল ১১টা ৪০ মিনিট: প্রতিস্থাপন শুরু। চলে পাঁচ ঘণ্টা।
--------------------------------------------------------------
এক নজরে
• হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন কী?
দাতা ও গ্রহীতার রক্তের গ্রুপ, দেহের ওজন, অ্যান্টিবডির মতো বিভিন্ন শারীরিক উপাদান মিলে গেলে হৃৎপিণ্ডের বিভিন্ন অংশ যেমন অলিন্দ, নিলয় একের পর এক গ্রহীতার দেহ থেকে তোলা হয়। এবং দাতার হৃৎপিণ্ডের অংশগুলি পরপর বসানো হয়। এই পুরো প্রক্রিয়াকে হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন বলা হয়।
• প্রতিস্থাপনের সংখ্যা?
এ দেশে বছরে প্রায় ১৫০ হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপনের অস্ত্রোপচার করা হয়। চেন্নাই, দিল্লি-সহ দেহের বিভিন্ন প্রান্তে এই প্রতিস্থাপন হয়। যদিও পূর্ব ভারতে সোমবারই প্রথম তা করা হল
• সাফল্যের হার?
প্রায় ৯০ শতাংশ রোগীর অস্ত্রোপচার সফল হয়। তবে, সাফল্য নির্ভর করে অস্ত্রোপচার পরবর্তী চিকিৎসা চালানোর উপর
• অস্ত্রোপচারের খরচ?
অস্ত্রোপচারের সময় প্রায় ৭-৮ লক্ষ টাকা খরচ হয়। প্রতিস্থাপনের পরে অস্ত্রোপচার পরবর্তী চিকিৎসা খরচ মাসে প্রায় ২০ হাজার টাকা।
এ দিন বিকেলে তাপসবাবু বলেন, ‘‘অস্ত্রোপচার সফল হয়েছে। তবে ৯৬ ঘণ্টা না কাটলে নিশ্চিত ভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না।’’ রাজ্যের অতিরিক্ত স্বাস্থ্য অধিকর্তা অদিতিকিশোর সরকার বলেন, ‘‘সফল হৃৎপিণ্ড প্রতিস্থাপন এ রাজ্যের চিকিৎসা পরিষেবাকে অনেক এগিয়ে নিয়ে গেল। তবে দাতার জন্য ভিনরাজ্যের উপর নির্ভর করতে হয়েছে। রাজ্যবাসী অঙ্গদান সম্পর্কে সতর্ক হলে কাজটা আরও সহজ হবে।’’