শিয়রে বিপদ: বিজ্ঞাপনের হোর্ডিংয়ের ভিড়ে প্রায় চোখেই পড়ে না পুরসভার নোটিস (চিহ্নিত)। বুধবার, ধর্মতলায়। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
বাড়ির গেস্ট হাউসে লোক উঠলেই আব্দার করেন, দোতলার বারান্দা থেকে ধর্মতলা মোড় দেখতে দিতে হবে। শত অনুনয়-বিনয়ের পরে প্রায় বাধ্য হয়েই সম্মতি দেন মালিক। সঙ্গে সর্তকবাণী, ‘‘বারান্দায় সাবধান। ইংরেজ আমলের বাড়ি তো! পা টিপে টিপে ঘুরে আসুন। বেশি ধারে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।’’ অতিথি যতক্ষণ বারান্দায় থাকবেন, তাঁর সঙ্গে পাহারায় থাকতে হয় গেস্ট হাউসের কোনও না কোনও কর্মীকেও।
শহরের প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলা মোড়ে, ২ নম্বর জওহরলাল নেহরু রোডের শতাব্দীপ্রাচীন বাড়িটির এমনই অবস্থা যে, কার্যত প্রাণ হাতে করে সেখানে বাস করছেন বাসিন্দারা। পুরসভা বাড়িতে বিপজ্জনক বোর্ড ঝোলালেও কোনও কাজ হয়নি। বাড়ির সংস্কার হয়নি। দু’টি গেস্ট হাউস ছা়ড়াও ব্যবসার কাজে বাড়িটির ৫৫টি ঘর ভাড়ায় নেওয়া। দোতলার ভঙ্গুর বারান্দার নীচে ব্যবসা করেন কয়েকশো হকার। বারান্দার নীচের ফুট ধরে রোজ যাতায়াত করেন অন্তত হাজারখানেক মানুষ! যে কোনও মুহূর্তে বিপদ ঘটতে পারে জেনেও বাড়ি ছাড়তে নারাজ ভাড়াটেরা। তাঁদেরই এক জন বুধবার বলেন, ‘‘বাইরেটা একটু লজ্ঝড়ে হলেও ভিতরটা একেবারে পোক্ত। এখানে কিছুই হবে না। ঝড়েও তো দেখলাম কিচ্ছু হল না!’’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাড়ির মালিকের বংশধর বলছেন, ‘‘পুরসভাকে জানিয়েছি। বাইরে বলতে চাই না।’’
এক দুপুরে গিয়ে দেখা গেল, তিনতলা ওই বাড়ির সামনের ভঙ্গুর বারান্দার উপরে লাগানো ‘বিপজ্জনক বাড়ি’ লেখা পুরসভার বোর্ড। আশপাশে একাধিক পণ্যের বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং। সেই হোর্ডিংয়ের ভিড়ে চোখেই পড়ে না পুরসভার বোর্ডটি। ভিতরে ঢুকে নড়বড়ে কাঠের সিঁড়ি পেরিয়ে দোতলায় উঠে দেখা গেল, ঘরের মেঝে থেকে ২০ ফুট উঁচুতে ছাদ। তার মাঝ বরাবর কাঠের নকল সিলিং তৈরি করানো হয়েছে। প্রতি তলেই রয়েছে একাধিক ভাড়ায় দেওয়া ব্যবসার ঘর। একেবারে উপরের তলায় দু’টি গেস্ট হাউস।
নরেন্দ্রকুমার আর্য নামে এক ভাড়াটে জানান, প্রায় সাড়ে ছ’কাঠা জমির উপরে এই বাড়ি। ইংরেজ আমলে এখানে ‘ব্রিস্টল’ হোটেল ছিল। প্লাস্টিকের শেড দিয়ে ঢাকা বড় বারান্দায় থাকত খানা-পিনার ব্যবস্থা। ঘরের মঝখানে ছিল ‘ডান্স ফ্লোর’। পরে এই বাড়ি ইংরেজদের থেকে পান দেবব্রত গুপ্ত নামে এক ব্যক্তি। তাঁর কাছ থেকে পরে বাড়িটি নেন পি সি মিত্র নামে আর এক জন। পরে নানা হাত ঘুরে এখন এই বাড়ি ভাড়াটেদের ‘দখলে’। নরেন্দ্রকুমার বলেন, ‘‘এই বাড়ি আমরাই দেখি। আমাদের ভাড়াটেদের সংগঠন সমস্তটা দেখাশোনা করে। ভিতরের সবটাই আমাদের টাকায় সংস্কার হয়েছে। পুরসভা বাইরের কাজটা করতে দিচ্ছে না। তাই হচ্ছে না।’’
তবে ইদানীং কয়েক জন নিজেদের মালিক হিসেবে দাবি করে বাড়ি ফাঁকা করে দেওয়ার চাপ দিচ্ছেন বলে অভিযোগ ভাড়াটেদের সংগঠনের সদস্য রঞ্জিত কর্মকারের। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা ছাড়ব না। আইনের দ্বারস্থ হয়েছি। আর পুরসভাও বাড়ি সংস্কার করতে দিচ্ছে না আমাদের।’’ যদিও পুরসভা সূত্রে জানানো হয়েছে, ওই বিপজ্জনক বাড়ি সংস্কারের জন্য একাধিক নোটিস পাঠানো হয়েছে। তাতে কোনও কাজ হয়নি। এর পরে পুর আধিকারিকেরা খতিয়ে দেখে বাড়িটিকে বিপজ্জনক ঘোষণা করেন। এখন বাড়িটি সে ভাবেই পড়ে রয়েছে।
পুরনো বাড়ি সংস্কারের জন্য লাগাতার প্রচার চালাচ্ছে পুরসভা। সম্প্রতি বাড়ি সংস্কার সংক্রান্ত নিয়মও ঢেলে সাজা হয়েছে। তার পরেও শহরের প্রাণকেন্দ্র বিপজ্জনক বাড়িতে এতগুলি অফিস চলায় আশঙ্কায় রয়েছেন অনেকেই। যদিও এক পুর আধিকারিক বলেন, ‘‘বিষয়টি আমাদের নজরে আছে। একাধিক বার পরিদর্শনেও গিয়েছি। এ বার কী করা যায়, তা নিয়ে আলোচনায় বসব।’’
কিন্তু তার আগেই যদি বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটে যায়, তার দায় কে নেবে? এই প্রশ্নের উত্তর অবশ্য মেলেনি।