বাবার কথা শুনলেই হত, আক্ষেপ একরত্তি মেয়ের

গত ১ এপ্রিল ছেলে, মেয়ে এবং স্ত্রীকে নিয়ে ইকো পার্কে ঘুরতে গিয়েছিলেন সুব্রত নায়েক। ‘ট্রাম্পোলিন মিকি মাউসে’ ছেলে-মেয়েকে চড়ানোর বিশেষ ইচ্ছে ছিল না বাবার।

Advertisement

সৌরভ দত্ত

শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০১৮ ০১:৫৭
Share:

মায়ের কোলে রিয়ান। —নিজস্ব চিত্র

তিন বছরের ভাইয়ের বাড়ি ফেরার দিন আর জেদ না করার অঙ্গীকার করল সাত বছরের দিদি।

Advertisement

গত ১ এপ্রিল ছেলে, মেয়ে এবং স্ত্রীকে নিয়ে ইকো পার্কে ঘুরতে গিয়েছিলেন সুব্রত নায়েক। ‘ট্রাম্পোলিন মিকি মাউসে’ ছেলে-মেয়েকে চড়ানোর বিশেষ ইচ্ছে ছিল না বাবার। মেয়ে জেদ করায় সুব্রতবাবু অনুমতি দিয়েছিলেন। আচমকা ঝড়ে সেই রাইড থেকে পড়ে গুরুতর জখম হয় মনীষা এবং তার ভাই তিন বছরের রিয়ান। যার প্রেক্ষিতে নারায়ণপুরের ফ্ল্যাটে বসে মনীষা বলে, ‘‘পাপা, মাম্মি সরি। আমি আর জেদ করব না!’’

ভাই এখন অনেকটাই সুস্থ। তবে তার ডান চোখের দৃষ্টি ফিরবে কি না, নিশ্চয়তা নেই। মাঝেমধ্যেই তার পেটে এবং ঘাড়ে প্রবল যন্ত্রণা হচ্ছে। তবে সে দিকে কোনও হুঁশ নেই একরত্তির মেয়েটির। নারায়ণপুরে দাদু সুনাকর নায়েক এবং ঠাকুরমা মঞ্জুষা নায়েকের সঙ্গে সোফায় বসে থাকা শিশুকন্যাকে মাঝেমধ্যেই ঘিরে ধরছে দুশ্চিন্তা।

Advertisement

দাদু, ঠাকুরমা নাতি-নাতনির দুষ্টুমি, তাদের শারীরিক পরিস্থিতি, প্রিয় কার্টুন চরিত্র, ছেলের চাকরি নিয়ে কথা বলছেন। মনীষার দৃষ্টি কিন্তু তখন শূন্যে নিক্ষিপ্ত। কার্টুন চরিত্রের প্রসঙ্গে ভাই এবং তাঁর পছন্দ যে ডোরেমন, তা জানিয়ে আবার চুপ সে। ডান চোখের পাতার নীচে এখন খচখচ থাকায় বারবার আঙুল দিয়ে অস্বস্তি দূরের চেষ্টা করছে নিউ টাউনের একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ওই ছাত্রী। দাদু জানান, সারাক্ষণ নিজেকে দোষারোপ করে চলেছে মনীষা। ভাবছে ওর জন্যই রিয়ানের এমন ভোগান্তি হল। মনীষা বলে, ‘‘ভাই হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে, এটা দেখতে ভাল লাগছিল না।’’

দুর্ঘটনার তিন সপ্তাহ পরে সল্টলেকের দত্তাবাদ সংলগ্ন বেসরকারি হাসপাতাল থেকে নারায়ণপুরের ফ্ল্যাটে ফিরেছে রিয়ান। এ দিন চিকিৎসক এস এন সিংহ বলেন, ‘‘অ্যাম্বুল্যান্সে হাসপাতালে আনার পরে রিয়ানের হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। যখন ও ভর্তি হল, তখন একেবারে কোমায়। সেখান থেকে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে। শারীরিক দুর্বলতা বিশ্রাম নিলে ঠিক হয়ে যাবে।’’ তিনি বলেন, ‘‘জয় রাইড থেকে পড়ে আঘাত লাগায় মনীষার ডান চোখে এখন দৃষ্টি নেই। চোখের ওই জায়গায় অস্ত্রোপচার করা সম্ভব নয়। ওষুধের উপরে ভরসা রাখছি।’’ চিকিৎসক অভিষেক পোদ্দার বলেন, ‘‘তিন সপ্তাহের মাথায় যে রিয়ান এবং মনীষার সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে, এটা অসাধারণ। খুবই সঙ্কটজনক ছিল ওদের অবস্থা।’’

আইসিইউ থেকে বেরোনোর পরে মনীষার ডান চোখের সমস্যার কথা জানা যায়। দাদু সুনাকর বলেন, ‘‘নাতনির ডান চোখে যে সমস্যা হচ্ছে, আমি প্রথম বুঝতে পারি।’’ সেই থেকে মেয়েকে নিয়ে ছোটাছুটি করছেন সুব্রতের। ঘটনার পর থেকে সে ভাবে বাড়িই ফেরেননি তিনি। হিডকো চিকিৎসার খরচ দেওয়ার পাশাপাশি সুব্রত ও কল্পনার জন্য বেসরকারি হাসপাতালের কাছে একটি হোটেলের ব্যবস্থা করেছিল। মুকুন্দপুরে মেয়েকে এক চক্ষু বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যান বাবা। সুব্রত বলেন, ‘‘মেয়ে বলছে, বাবা মন খারাপ করো না। এক চোখে তোমাদের তো দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু বাবা তো! ওইটুকু মেয়ের সামনে সারা জীবন পড়ে। ডান চোখের মণি মাঝেমধ্যে স্থির হয়ে যাচ্ছে। সেটা দেখতে ভাল লাগে না।’’ গলা বুজে আসে তাঁর। নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, ‘‘চোখের চিকিৎসা নিয়ে যদি কেউ খোঁজ দিতে পারেন, উপকার হবে।’’ মা কল্পনা বলেন, ‘‘রিয়ান বাড়ি ফেরায় খুশি। কিন্তু মেয়ের জন্য খারাপ লাগছে।’’

আর মনীষা বলছে, ‘‘বাবা যখন বারণ করল, তখন যদি কথা শুনতাম! বাবা-মা কাছে জেদ করা উচিত নয়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন