‘যদি কোনও একটা কাজ করতে পারতাম’

তিনি সেই শেখ আব্দুল হুদা। পেশায় রাজমিস্ত্রি। সে দিন তাঁর কাজ ছিল না। তাই অন্য রাজমিস্ত্রিদের খাবার পৌঁছে দেওয়ার ডিউটি প়়ড়েছিল। খাবার দিয়ে আপনমনে ফিরছিলেন বিডন স্ট্রিটের ডেরায়।

Advertisement

সুনন্দ ঘোষ

শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০১৮ ০২:১৬
Share:

এ ভাবেই উড়ালপুলের তলায় চাপা পড়েছিলেন আব্দুল। —ফাইল চিত্র।

কয়েক মিনিট কথা বলার পরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন তিনি। এ ভাবে বেঁচে থাকতে হবে, দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি কোনও দিন।

Advertisement

তিনি সেই শেখ আব্দুল হুদা। পেশায় রাজমিস্ত্রি। সে দিন তাঁর কাজ ছিল না। তাই অন্য রাজমিস্ত্রিদের খাবার পৌঁছে দেওয়ার ডিউটি প়়ড়েছিল। খাবার দিয়ে আপনমনে ফিরছিলেন বিডন স্ট্রিটের ডেরায়। পোস্তার নির্মীয়মাণ উড়ালপুলের তলা দিয়ে যাওয়ার সময়ে চোখের সামনে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে সেতু। উল্টো দিকে পালানোর জন্য ঘুরতে গেলেই চোখের সামনে অন্ধকার নেমে আসে। কয়েক মুহূর্ত পরে জ্ঞান ফিরতেই তিনি দেখেন, কোমরের তলা থেকে চাপা পড়ে গিয়েছে সেতুর ভগ্নাংশের তলায়।

দেখতে দেখতে দু’বছর পেরিয়ে গেল। সেই অভিশপ্ত দিনে অকুস্থলের প্রধান মুখ হয়ে উঠেছিলেন আব্দুল হুদা। কোমরের তলা থেকে সেতুর তলায় চাপা। উপরের অংশ খানিকটা বাইরে। পরণে ছাই রঙের জামা। অনেকেই দেখে ভেবেছিলেন, শহরে ট্যাক্সি চালান তিনি। একটি ট্যাক্সির পাশে তাঁর ছবি উঠেছিল পরপর। চোখটা কোনওমতে খোলা। আব্দুলকে বারবার জল খাইয়ে, বুঝিয়ে, মনের জোর বাড়ানো হচ্ছিল।

Advertisement

ওই ভাবে চার ঘণ্টারও বেশি সেতুর তলায় চাপা পড়েছিল আব্দুলের অর্ধেক দেহ। উদ্ধারের পরে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। পরপর কতগুলো অস্ত্রোপচার হয়েছিল, আজ আর মনে করতে পারেন না আব্দুল। সেখান থেকে মাস তিনেক পরে ফিরলেন মুর্শিদাবাদের রেজিনগরের মধুপুর গ্রামের একচালা বাড়িতে। একচালা এক ঘরে খাটের মধ্যে সেই বন্দিদশা এখনও কাটেনি তাঁর।

দুই স্ত্রী গুরফুন্নিসা ও আলিয়া। একসঙ্গেই থাকেন। তাঁরা দু’জনেই বিড়ি বাঁধার কাজ করেন। গুরফুন্নিসা বড়। তাঁর তিন ছেলেমেয়ে। আলিয়ার চার। বড় ছেলে সুফিউর রহমান সিভিক পুলিশের কাজ করেন। আব্দুল হুদার বয়স এখন মেরেকেটে ৪৬। সুফিউরের বয়স ২৩। তিনি বিএ পাশ করেছেন। মাস সাতেক আগে বিয়েও করেছেন। আব্দুল বলেন, ‘‘আমার সবচেয়ে চিন্তা ছোট ছেলেকে নিয়ে। মাসুম রানার বয়স এখন মাত্র পাঁচ বছর।’’

পাঁজরের হাড় ভেঙেছিল আব্দুলের। সঙ্গে কোমরও। অকেজো হয়ে গিয়েছে বাঁ পা। খালি পায়ে হাঁটতে পারেন না। দুর্ঘটনার জন্য সরকার ২ লক্ষ টাকা ক্ষতিপুরণের সঙ্গে বাঁ পায়ের হাঁটু থেকে নীচ পর্যন্ত পরার জন্য একটি ‘ব্রেস’ দিয়েছিল। সেটা পরলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে পারেন তিনি। কিন্তু কোমরের ব্যথার জন্য কোথাও দু’দণ্ড বসতে পারেন না। এই অবস্থায় কোনও ধরনেরই কাজ করতে পারছেন না বলে জানান আব্দুল। দুই স্ত্রী ও ছেলের রোজগারেই ১১ জনের সংসার কোনও মতে চলছে সেই থেকে। বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ বলতে একটা মোবাইল ফোন। নিজে থেকে কাউকে ফোন করেন না। কথা বলার দরকার হলে এক বার ফোন বাজিয়ে কেটে দেন। তবু ফোনের টাকা শেষ হয়ে যায়। জানান, ছোটবেলার বন্ধু অনন্ত তাঁকে ভাইয়ের মতো ভালবাসেন। তিনিই কখনও পাঁচ টাকা, কখনও দশ টাকা ভরিয়ে দেন ফোনে।

এ সব কথা বলতে গেলে গলা বুজে আসে আব্দুলের। তিনি বলেন, ‘‘দাদা, এক সময়ে এক বস্তা স্টোন-চিপস্‌ মাথায় নিয়ে গিয়েছি। এক বারে মাটি থেকে এক বস্তা সিমেন্ট মাথায় তুলে নিতাম। এখন শুধুই গঞ্জনা শুনতে হয়!’’

কে গঞ্জনা দেয়?

ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে কিছু ক্ষণ আর শব্দ শোনা যায় না। একটু পরে থেমে থেমে আব্দুল বলেন, ‘‘দু’টো হাত এখনও শক্ত রয়েছে। কিছু কাজ করা যায় কি না, তা নিয়েই ভেবে চলেছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন