দু’জনে: রবীন্দ্র সদন এবং কালীঘাট মেট্রো স্টেশনে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়। নিজস্ব চিত্র
মেট্রো আরোহীদের ‘কলকাতার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ বজায় রাখা উচিত— সম্প্রতি মেট্রো রেলে আলিঙ্গনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে গণরোষ এবং পিটুনির ঘটনা ঘটার পরে এমনই বিবৃতি দিয়েছিলেন মেট্রো রেল কর্তৃপক্ষ। তাঁদের এই বিবৃতির অর্থ ঠিক কী, গোড়ায় তা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন শহরের বিশিষ্টজনেরা। দিন গড়াতেই যদিও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে মেট্রো কর্তৃপক্ষের অবস্থান। সেই সঙ্গে জোরালো হয়েছে বিতর্কও।
‘‘মেট্রো কর্তৃপক্ষকেই প্রশ্ন করা উচিত, কলকাতার সংস্কৃতি বলতে তাঁরা ঠিক কী বোঝেন?’’— বক্তব্য ভাষাবিদ পবিত্র সরকারের। সঙ্গে তাঁর মন্তব্য, বরাবরই কলকাতার সংস্কৃতি সহিষ্ণুতা। মেট্রো কর্তৃপক্ষের শব্দটি পছন্দ হবে কি না, তা অবশ্য অন্য প্রশ্ন। তবে অন্তরঙ্গতা প্রকাশের ভঙ্গি নিয়েও নির্দিষ্ট মন্তব্য করেছেন পবিত্রবাবু। তাঁর মতে, দেখা হলে আলিঙ্গন করা নতুন নয়। তবে তা কী ভাবে করা হচ্ছে, সেটা ভাবার বিষয়। কিন্তু তা নিয়ে নীতি-পুলিশি করার নৈতিক অধিকার সাধারণ মানুষেরও নেই, পুলিশেরও নেই।
এ নিয়ে আবার এত আলোচনার মধ্যেই অবশ্য ঢুকতে চান না নবনীতা দেবসেন। উল্টে তাঁর শ্লেষ, ‘‘মারধর করা, গণধোলাই দেওয়াই আসলে কলকাতার সংস্কৃতি।’’ তাঁর আক্ষেপ, ‘‘বহু ভাষাভাষীর এই শহরে এক জন মানুষ অন্য জনকে জড়িয়ে ধরতে পারবে না!’’
আধুনিক কলকাতার সংস্কৃতি সংক্রান্ত আলোচনায় সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, এক কথায় ‘কলকাতার সংস্কৃতি’ শব্দবন্ধটিই বিচিত্র। কারণ, শহরের সংস্কৃতি একমাত্রিক নয়। এ শহর বহুভাষিক, বহুবাচিক। বহু কিছুর মিশেলে তৈরি হয়েছে এক বহুত্ববাদী সংস্কৃতি। তৈরি হয়েছে একটি আচরণগত ধরন। দুঃখজনক হলেও সেই ধরনের মধ্যে বরাবরই গণধোলাই বিষয়টি ছিল। অপসংস্কৃতি হলেও কলকাতার চরিত্রে গণধোলাই চিরকালীন। দ্রুত যাতে তা বন্ধ করা যায়, সে দিকে নজর দেওয়া দরকার। পাশাপাশি তিনি চান না, গোটা কলকাতা লন্ডনের হাইড পার্ক হয়ে উঠুক। বস্তুত, লন্ডনের হাইড পার্ক স্বাধীনতার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। সেখানে যে কেউ যা খুশি করতে পারেন। কখনও কখনও যা স্বেচ্ছাচারিতা বলেও কেউ কেউ মনে করেন। প্রকাশ্যে চুম্বন বা আলিঙ্গনের মতো বিষয়গুলিকে সে ভাবেই দেখতে চাইছেন শীর্ষেন্দুবাবু। তাঁর মত, মানুষ বৃহত্তর বিষয় নিয়ে চিন্তা করুক। ‘‘দেশ জুড়ে বহু সমস্যা। কোথা থেকে উড়ে এল নতুন এই বিষয়! ভালবাসতে তো ক্ষতি নেই, কিন্তু ভব্যতা বজায় থাকুক।’’
কবি শ্রীজাতের কাছে কলকাতার সংস্কৃতি হল বড় ভাষার মতো। যা অনেক কিছু ধারণ করতে পারে। তাঁর বক্তব্য, ‘‘বহু ভাষাভাষী শহরের সংস্কৃতি বহুত্ববাদী। বহু সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে তা গ্রহণ করতে পারে। সেই সংস্কৃতিতে আলিঙ্গন তো খুব চমৎকার বিষয়! আলিঙ্গন বন্ধুকে হতে পারে, ভাইকে হতে পারে, প্রেমিকাকেও হতে পারে। এটাই কলকাতার সংস্কৃতি।’’ শ্রীজাতের আশঙ্কা, আজ যা মেট্রোয় ঘটছে, কাল তা-ই তাঁর বাগানে ঘটবে। তাঁর বক্তব্য, অসহিষ্ণু মানুষের প্রতিক্রিয়া সর্বত্র একই রকম।
অভিনেতা ঋদ্ধি সেন মেট্রোর ঘটনা নিয়ে লিখেছিলেন সোশ্যাল নেটওয়ার্কে। তাঁর মতে, প্রকৃতির সামনে কলকাতা, সংস্কৃতি, মানুষ শব্দগুলি নেহাতই ছোট। একটা ঝড় হলে শত শত মানুষের মৃত্যু হয়। কেউ কিছু করে উঠতে পারেন না। তার পরেও সাধারণ এবং স্বাভাবিক কিছু ঘটনা নিয়ে মানুষ এত উত্তেজিত হয়ে পড়েন কেন, এটাই আশ্চর্যের। ঋদ্ধির বক্তব্য, ‘‘প্রতিটি মানুষ তাঁদের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য নিয়ে বাঁচলেই এই সব সমস্যা তৈরি হয় না। সংস্কৃতি বলে যদি কিছু থেকে থাকে, তা হলে তা হোক ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের।’’