স্কুলবাস: যাতায়াত এখন এমনই আনন্দের। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী
বিয়ে হয়েছিল ১৫ বছর বয়সে। বিয়ের আগে কিশোরী স্ত্রী স্বামীকে শর্ত দিয়েছিল, তাকে পড়তে দিতে হবে। স্বামী কথা রাখেননি। তাই ডিভোর্সের মামলা করেছে দশম শ্রেণির ছাত্রী খুশনু পরভিন। তিন বছরের কন্যাসন্তানের মা বলে, ‘‘পড়াশোনা শিখে নিজের রোজগারে মেয়েকে মানুষ করে দেখিয়ে দেব।’’ এই দেখিয়ে দেওয়ার পণ নিয়েছে গুলশন খাতুন এবং সানিয়া আহমেদও। গুলশনের কথায়, ‘‘দিদিদের হারতে দেব না।’’
টিকে থাকার লড়াইয়ে, জিততে চাওয়ার লড়াইয়ে এখন যে একজোট ‘দিদি’রা এবং ছাত্রীরা।
এন্টালির ডক্টর সুরেশ সরকার রোডে ১৯৫০ সালে তৈরি সারদা বিদ্যাভবন বাঁচানোর ভাবনাচিন্তা চলছিল ২০১৬ সাল থেকে। ছাত্রীসংখ্যা টেনেটুনে যেখানে ছিল ১৫০, তা নেমে দাঁড়িয়েছিল ৮০-তে। কারণ, এন্টালির মতো এলাকায় বাংলা মাধ্যম স্কুলে সন্তানদের পড়তে পাঠাতে অনিচ্ছুক ছিলেন বাবা-মায়েরা। ২০১৭-য় মাঠে নেমে স্কুল বাঁচানোর লড়াই শুরু করেন দুই শিক্ষিকা অপর্ণা বিশ্বাস এবং অজন্তা রায়। স্কুলছুটদের খোঁজে তপসিয়ার পাড়ায় পাড়ায় ঘুরতে শুরু করেন তাঁরা। সঙ্গে ছিলেন প্রধান শিক্ষিকা সুরমা বন্দ্যোপাধ্যায়, শিক্ষিকা মহাশ্বেতা মুখোপাধ্যায়, মীনাক্ষী দাশগুপ্ত, গোপা পাণ্ডে।
ছাত্রীদের স্কুলে আনার কাজটা কিন্তু সহজ ছিল না। বাংলা মাধ্যম স্কুলে কেন মেয়েদের পাঠাবেন, প্রথমেই সেই প্রশ্ন করেন অভিভাবকেরা। দ্বিতীয় সমস্যা যাতায়াতের খরচ।
বাবা-মায়েদের প্রশ্ন ছিল, ২৪ টাকা খরচ করে তপসিয়া থেকে এন্টালির স্কুলে পাঠাবোই বা কেন? স্কুলে যেতে ইচ্ছুক আয়েষা বলেছিল, ‘‘মা তো দু’টাকাই দিতে চায় না! ২৪ টাকা খরচ করব কোথা থেকে?’’ এই প্রশ্নের উত্তর দিতেই ছাত্রীদের জন্য বাস ভাড়া করেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। আর প্রতি মাসে ২৩ হাজার টাকা বাসের ভাড়া মেটাতে নিজেদের বেতনের একাংশ দিতে দ্বিধা করেননি দিদিমণিরা। সাহায্য মিলেছে স্কুল তহবিল থেকেও।
তবে নিজেদের লড়াইটা বড় নয় বলেই মনে করেন গুলশনের দিদিরা। বরং ছাত্রীদের নিত্যদিনের লড়াইয়ে শরিক হতে পেরেই তাঁরা খুশি। প্রধান শিক্ষিকা বলেন, ‘‘খুশনুরা প্রতিষ্ঠিত হোক। আমাদের লড়াইটা বাইরের জগতের সঙ্গে। ওদের লড়াইটা একেবারে ঘরের ভিতরে।’’ আর যখন সেই ঘরের লড়াই জিতে আসা সানিয়া বলে, ‘‘স্কুলে এলে আর যেতে ইচ্ছা করে না। মনে হয়, এখানেই থেকে যাই।’’ তা শুনে গর্বের হাসি চওড়া হয় শিক্ষিকাদের। বাড়ে লড়াইয়ের জেদও। কারণ, এন্টালির মতো এলাকায় ছাত্রী সংখ্যা কমে আসা স্কুলবাড়িতে নজর পড়েছিল প্রোমোটারের। ঘটনাচক্রে, বাড়িটি মেজো জামাইকে দিয়েছিলেন রানি রাসমণি। সে জন্য সেটি ‘হেরিটেজ গ্রেড ওয়ানে’র মর্যাদাপ্রাপ্ত। হেরিটেজ কমিশনে গিয়ে সে সমস্যা আপাতত সামলে নেওয়া গিয়েছে। এখন চিন্তা ছাত্রীর সংখ্যা বাড়ানো। অপর্ণাদেবী বলেন, ‘‘একটা বাসে ছাত্রীরা গাদাগাদি করে আসে। আরও একটা বাস পেলে আরও ছাত্রীকে স্কুলে আনতে পারতাম। অত টাকা কোথায়!’’