দীপাবলিতে মহাকাশ থেকে ভারতকে এ রকম দেখাচ্ছে— এই বলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়েছে এমন ভুয়ো ছবি।
রবিবার, পয়লা এপ্রিলের সকালেই ফোনে ফোনে ঘুরছিল সতর্কবাণী।
নাইজিরিয়ায় উদ্যত ছুরি হাতে জনৈক হামলাকারীর ছবি প্রচার করে তা বাংলার কোনও অঞ্চলে গোষ্ঠী-হিংসার ছবি বলে চালানো হচ্ছে। মূল ছবিটির উৎস নির্দিষ্ট করে আর্জি, ‘বুদ্ধি খাটান। অপপ্রচারের ফাঁদে পা দেবেন না।’
নেটজনতার কাছে অজানা নয়, এ সব বোকা বানানোর কৌশল। কোথাও উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর খেলা চলছে। কখনও বা কুমির ছানা দেখানোর কৌশল। গোষ্ঠী সংঘর্ষে ইন্ধন জোগাতে বছরখানেক আগে দু’টোই দেখা গিয়েছিল উত্তর ২৪ পরগনার কিছু অশান্তির পটভূমিতে। এ দেশে ইন্টারনেটে ভুয়ো খবর জরিপ করার কাজে যুক্ত একটি সংস্থা অল্টনিউজ পরপর মেলে ধরেছিল কুমতলবে ছড়ানো এই ধরনের সব ছবি। তখনই মালুম হয়, কী ভাবে বাংলাদেশে সিঁদুরপরা এক মহিলার জখম হওয়া রক্তাক্ত ছবি পর্যায়ক্রমে কুমির ছানা দেখানোর ঢঙেই ধূলাগড় কি বসিরহাটের অশান্তির সময়ে প্রচার করা হচ্ছে। বাংলার নারীর সম্ভ্রম বিপন্ন বোঝাতে আরও চমৎকার কৌশল অবলম্বন করা হয়। ভোজপুরি ছবি ‘আওরত খিলোনা নেহি’র এক তরুণীর আঁচল ধরে টানাটানির ছবি ছড়িয়ে বাংলার ‘মা-বোনেদের বস্ত্রহরণ-কাহিনি’ ফাঁদা হয়েছিল।
অল্টনিউজ-এর কর্ণধার প্রতীক সিংহের মতে, যা দিনকাল তাতে রোজই কেউ না কেউ, কোথাও না কোথাও এ ভাবে ‘এপ্রিল ফুল’ হচ্ছেন। নেটদুনিয়ার সোশ্যাল মিডিয়ায় ৩৬৫ দিনই ‘এপ্রিল ফুল ডে’। ‘‘কিন্তু হিংসা ছড়ানোর মতলবে ভুয়ো খবর প্রচার এ দেশে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। প্রমাণ হলে নির্দিষ্ট ধারায় পাঁচ বছরের জেলও হতে পারে।’’— বলছেন সাইবার আইন বিশেষজ্ঞ বিভাস চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু নেটদুনিয়ায় মেঘনাদের মতো ভুয়ো নামের আড়ালে লুকিয়ে কে কী করে বেড়াচ্ছেন ধরা সোজা নয়। প্রতীক বলছিলেন, ‘‘হোয়াটসঅ্যাপে ছড়ানো ভুয়ো খবরগুলোই সব থেকে বিপজ্জনক।’’ কারণ, অজ পাড়াগাঁয়েও লোকে হোয়াটসঅ্যাপ চেনেন আজকাল। তাঁরা হয়তো গুগলের নাম শোনেননি। ইন্টারনেটে একটি ছবির উৎস খোঁজা বা তথ্য যাচাই করতে কী করতে হয়, কিছুই জানেন না। এই অবস্থায় বোকা বনা ছাড়া অনেকের জন্যই উপায় থাকে না।
তবে এই বোকা হওয়ার বিপদে তথাকথিত শহুরে শিক্ষিত লোকও সব সময়ে নিরাপদ নন, মনে করেন মনোরোগের চিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম। তাঁর কথায়, ‘‘প্রযুক্তির দৌলতে এক ধরনের কৃত্রিম বুদ্ধি আমাদের নাগালে এসেছে। তার মানেই গণহারে বুদ্ধি বেড়েছে তা তো নয়!’’ অর্থাৎ এক রকমের অন্ধ বিশ্বাসের খপ্পরে পড়ে ইন্টারনেটের যে কোনও ধ্রুব সত্য মেনে নেওয়ার লোকও সর্বত্র রয়েছেন। মনোবিদদের মতে, বেশির ভাগ মানুষই যা বিশ্বাস করতে চান, তা-ই বিশ্বাস করেন। যা রটে তার খানিকটা ঘটে ধরে নিয়ে মজ্জাগত ভুল ধারণাই শেষ কথা বলে।
অনেক ধরনের নির্দোষ মিথ্যেও ছড়াচ্ছে মুড়ি-মুড়কির মতো। মুম্বইয়ের নামী শিল্পপতির ছেলের বিয়ের স্বর্ণখচিত বিয়ের কার্ডের ছবি থেকে শুরু করে দীপাবলির দিন মহাকাশ থেকে আলোকোজ্জ্বল ভারতের ভুয়ো ছবিও অজস্র লোকে বিশ্বাস করেন। গণহারে বোকা হওয়ার প্রতিযোগিতায় আজকের নেটজনতাও সচরাচর বোঝেন না, ‘সামনে যা দেখি, জানি না সে কী, আসল কি নকল সোনা’।