শ্যাম স্কোয়ারের পুজো। মঙ্গলবার। —সুমন বল্লভ
পুজো-কালীপুজো শেষে উৎসবের স্লগ ওভারের ঝাঁঝ? নাকি পুজোর মজার অপূর্ণ সাধ মিটিয়ে নেওয়ার ধুম?
জবাবটা হয়তো ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’! তবে লালবাজারের কর্তারা বিষয়টা হাল্কা ভাবে নিতে পারছেন না।
এটা ঠিকই, জগদ্ধাত্রী পুজোয় মাতামাতি থাকলেও এখনও পর্যন্ত কলকাতার এ মুড়ো-ও মুড়ো চষে ফেলে ঠাকুর দেখার বাড়াবাড়ি তত নেই। তাই ঠিক এখনই চন্দননগর হয়ে ওঠার সম্ভাবনা নেই কলকাতার। তবে ভাসানের তুমুল উল্লাস নিয়ে ভালই টেনশন রয়েছে পুলিশের। কারণ, পুজোটা যে দ্রুত বহরে-গতরে ফুলেফেঁপে উঠছে, তা নিয়ে সংশয় নেই।
বেশ কয়েক বছর আগে এ পুজোর দাপট আটকে থাকত সাবেক কলকাতার চৌহদ্দিতে। উত্তরের গৌরীবাড়িতে ‘হেমেন মণ্ডলের পুজো’ বলে খ্যাত বারোয়ারির রমরমা তখন একবাক্যে মানত গোটা শহর। কালীপুজোয় ‘ফাটাকেষ্টর পুজো’র জবাব যেন ‘হেমেনের জগদ্ধাত্রী’। ওই পুজোয় সত্তরের দশক জুড়েই টালিগঞ্জের কেউকেটাদের দেখা মিলত। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মন্ত্রী সাধন পাণ্ডে সে পুজো উদ্বোধন করার পটভূমিতে বিচিত্র স্মৃতি আছড়ে পড়ছিল।
জগদ্ধাত্রীর সৌজন্যে ফি-বছর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একবার অন্তত যান পোস্তায় ব্যবসায়ীদের পুজোর মণ্ডপে। সোমবার পুজোটি উদ্বোধন করে গিয়েছেন তিনি। সাবেক উত্তর কলকাতা বরাবরই জগদ্ধাত্রী দেবীর খাস তালুক, কিন্তু ইদানীং দক্ষিণ কলকাতাও খানিকটা লড়ে যাচ্ছে। মানিকতলা থেকে গোটা উত্তর কলকাতায় সাধনবাবু যদি তিন দিন ধরে ৩০-৩৫টি পুজো উদ্বোধনে ব্যস্ত থাকেন, দক্ষিণে মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের ডায়েরিতে টালিগঞ্জ এলাকায় কয়েক ঘণ্টার মধ্যে উদ্বোধনযোগ্য খান চোদ্দো নতুন-পুরনো পুজোর নাম। শাসক দলের নেতা স্বপন সমাদ্দারের হাতযশ-ধন্য ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের অঙ্গীকার ক্লাব বা ভারতী সঙ্ঘের মণ্ডপে সন্ধেয় ঢুকলেন সাধনবাবু। দক্ষিণে অরূপের গাড়ি তখন ছুটছে ১১৪ নম্বরের সাহা ব্রাদার্স, কামডহরির সুপ্রভাত ছাড়িয়ে ১১৩ নম্বর ওয়ার্ডে আনকোরা আমবাগানে ‘আমরা সবাই’-এর মণ্ডপে।
লালবাজারের নথি বলছে, গত তিন-চার বছরে কলকাতা পুলিশ এলাকায় ধাপে-ধাপে অন্তত শ’দুয়েক বারোয়ারি পুজো বেড়ে গিয়েছে। কম সে কম ৫১৫টি পুজো হচ্ছে খাতায়-কলমে। আর গাদাখানেক বাড়ির পুজোর তো ইয়ত্তা নেই। পরম্পরামাফিক পুজোর সংখ্যায় গোটা শহরে এগিয়ে সেই উত্তর কলকাতা। তবে দক্ষিণের প্রান্তে যাদবপুর থেকে গড়িয়া, টালিগঞ্জ থেকে বাঁশদ্রোণীতেও হু-হু করে বাড়ছে জগদ্ধাত্রীর জনপ্রিয়তা। ব্যাপারটা কী?
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় অবশ্য একে ভক্তির প্রাবল্য মানতে রাজি নন। ‘‘সে তো বাসন্তী পুজো, গণেশ পুজোও বাড়ছে। আর পাঁচটা পুজোর মতো জগদ্ধাত্রী পুজোরও বিনোদনের দিকটাই এখানে প্রধান।’’ বৌবাজারের পুরনো সুবর্ণবণিক পরিবারের সন্তান, মদনগোপাল দে-র উত্তরপুরুষ বিনোদবিহারী দে-র কাছেও কলকাতার জগদ্ধাত্রী-চর্চার একটি চিত্তাকর্ষক তত্ত্ব মিলল। বললেন, ‘‘উনিশ শতকে আমাদের বড়বাবা (মদনগোপাল দে)-র আমল থেকেই বেনেবাড়িতে দুর্গাপুজোয় ছুটি মেলে না বলে আফশোসের জায়গা ছিল। পুজোর সময়টা অনেকেই ব্যবসায় ব্যস্ত থাকতেন। তাই পরে পুষিয়ে নিতেই বোধহয় জগদ্ধাত্রী পুজোর চল।’’ তবে শোভাবাজার রাজবাড়ির গিন্নি নন্দিনী দেববৌরানি বললেন, ‘‘বিভিন্ন পরিবারের বিভিন্ন নিয়ম। অনেক বাড়িই দুর্গাপুজোর মতো বড় করে না হলেও জগদ্ধাত্রী পুজোও মন দিয়ে করে।’’ দর্জিপাড়ার মিত্তির বা বটকৃষ্ট পালদের পরিবারেও জগদ্ধাত্রী পুজো হয়। কয়েক বছর আগেও পাথুরিয়াঘাটার খেলাত ঘোষদের বাড়ির প্রয়াত কর্তা বাবুলাল ঘোষকে হাসিমুখে বিপুলসংখ্যক অতিথিকে ভুরিভোজে আপ্যায়ন করতে দেখা যেত।
উত্তর কলকাতার পাইকপাড়ার পুরনো বাসিন্দাদের জগদ্ধাত্রী পুজো এলেই মনে পড়ে যায় বলাই বিশ্বাসের পুজোর বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার কথা। হাতিবাগানের হারিয়ে যাওয়া রাধা সিনেমার মালিক বলাইবাবুর জগদ্ধাত্রী পুজোর নামডাক ছিল বটে! বড়বাড়ির বিলাসের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে মা দুগ্গার মতো জগদ্ধাত্রীও ক্রমশ বারোয়ারি দেবী হয়েছেন। তবু বাদুড়বাগানে বিদ্যাসাগর স্ট্রিটের জগদ্ধাত্রী পুজো মানেই পাড়ার সোনালি দিনগুলো সজীব হয়ে ওঠা। বাইপাসের ধারে বা সল্টলেক-নিউটাউনের ফ্ল্যাটে ‘দেশান্তরী’ পড়শিরা সক্কলে এই দিনটায় পাত পেড়ে লুচি, পোলাও খেতে পুরনো পাড়ায় আসবেনই। চন্দননগরের কেতায় তিন দিন ধরে পুজো কলকাতায় হয় না ঠিকই, কিন্তু সোমবারই এ পুজোর উদ্বোধন করে গিয়েছেন খোদ সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়।
ভূপেন বসু অ্যাভিনিউয়ে শ্যাম পার্কের জগদ্ধাত্রী পুজোতেও গোটা পাড়া যেন মাটি কামড়ে পড়ে থাকে। বিগ বাজেট পুজোয় বম্বে-খ্যাত জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, বিনোদ রাঠৌররা এ বার ধামাকা জমিয়ে দেবেন বলে শোনা গেল। শ্যামপুকুর, শোভাবাজার থেকে বাগবাজার— জগদ্ধাত্রী পুজোয় রাস্তা ‘জ্যাম’ হবেই হবে। এন্টালি ডাকঘরের কাছে কলকাতার ‘হকিপাড়া’র পুজো ‘আমরা ক’জন’-এর কর্তা বাসুদেব ভট্টাচার্য গর্বিত— ‘‘আলোর জৌলুসে আমাদের এন্টালিকেও চন্দননগর বলে মনে হবে!’’
দেখার মতো জগদ্ধাত্রী মিলবে টালার লেডিজ পার্কেও। পুজোর প্রাণশক্তি পাড়ার মেয়ে-বৌ রেবা ঘোষ, শিখা পাল, শর্মিলা গঙ্গোপাধ্যায়রা। স্থানীয় বিধায়ক মালা সাহাও এই বাহিনীতে সামিল। মেয়েরা নিজেরাই পুজোর মূল পুঁজি জোগাড় করেন। হরেক কিসিমের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাইরের নামজাদাদের সঙ্গে আসর জমিয়ে দেবেনও তারাই।
কলকাতার দুর্গা বা কালীপুজো যদি মণ্ডপে মণ্ডপে টো-টো কোম্পানির উপলক্ষ হয়, জগদ্ধাত্রী পুজো যেন ক্রমশ ম্লান শহুরে ‘পাড়া কালচার’ ঝালিয়ে নেওয়ার অবকাশ। পুজো হিসেবে আচার-বিচার বেশ কঠিন। আজ, পুজোর নবমীতেই একনাগাড়ে সকাল থেকে সন্ধে সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী— তিন দিনের আচার-অনুষ্ঠান সারা হবে। এর পরে সন্ধেয় সবাই মিলে গানবাজনা, জলসা-নাটক, ভুরিভোজের উল্লাস।
এ বছর পুজোটা বৃষ্টির অত্যাচারে অনেকটাই মাটি হয়েছিল। ভেসে যাওয়া এক নবমীর ক্ষতি, এই জগদ্ধাত্রী পুজোর নবমীতে শোধবোধ করে নিতে তাই বদ্ধপরিকর আমবাঙালি।