বরো-১১

বাম-বিজেপি ভোট কাটাকাটি কোথায় গড়ায়, মাপছে তৃণমূল

সাবেক কলকাতায় নিজেদের অস্তিত্ব ‘বিপন্ন’ হওয়ার আশঙ্কা থেকেই শহরের রাজনীতিতে প্রাধান্য বজায় রাখতে ১৯৮৫ সালে পুর-মানচিত্রে যাদবপুর-সহ ক’টি পঞ্চায়েত এলাকাকে যুক্ত করে বামফ্রন্ট সরকার। তাতে কলকাতা পুরসভার ওয়ার্ড সংখ্যা ১০০ থেকে এক লাফে বেড়ে হয় ১৪১। যাদবপুর বাম দুর্গ হওয়ায় সংযোজিত ৪১টি ওয়ার্ডে পুরভোটে বরাবর বাম আধিপত্য ছিল। প্রথম ধাক্কা ২০১০ সালে।

Advertisement

দেবাশিস দাস

শেষ আপডেট: ০৬ এপ্রিল ২০১৫ ০২:২০
Share:

সাবেক কলকাতায় নিজেদের অস্তিত্ব ‘বিপন্ন’ হওয়ার আশঙ্কা থেকেই শহরের রাজনীতিতে প্রাধান্য বজায় রাখতে ১৯৮৫ সালে পুর-মানচিত্রে যাদবপুর-সহ ক’টি পঞ্চায়েত এলাকাকে যুক্ত করে বামফ্রন্ট সরকার। তাতে কলকাতা পুরসভার ওয়ার্ড সংখ্যা ১০০ থেকে এক লাফে বেড়ে হয় ১৪১। যাদবপুর বাম দুর্গ হওয়ায় সংযোজিত ৪১টি ওয়ার্ডে পুরভোটে বরাবর বাম আধিপত্য ছিল। প্রথম ধাক্কা ২০১০ সালে। তার আগের বছর লোকসভা ভোটে ‘মমতা ঝড়’ বেগ দেয় বামফ্রন্টকে। এর জেরে গত পুরভোটে যাদবপুর ও সংলগ্ন এলাকার ১১ নম্বর বরোর ৭টি ওয়ার্ডের ৪টিতে জয়ী হয় তৃণমূল। বামেরা পায় ৩টি। তবে ২০১৪-এর লোকসভা ভোটে প্রবল মোদী হাওয়াতেও ভোট টানার লড়াইয়ে বিজেপি ছিল বামেদের পরে। পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকে কতটা শক্তি বাড়িয়েছে তৃণমূল? বামেদের ভোটব্যাঙ্ক অটুট থাকবে, না বিজেপির দিকে ভিড়বে— এ নিয়েই শুরু হয়েছে বরো ১১-র মহাযুদ্ধ।

Advertisement

সন্তোষপুর থেকে কেওড়াপুকুর খাল পর্যন্ত বিস্তৃত এই বরো। ১১০, ১১১, ১১৪ নম্বর ওয়ার্ডে ১৯৮৫ সাল থেকে পুরভোটে টানা জিতে এসেছে সিপিএম। কিন্তু ২০১৪-র লোকসভায় শেষোক্ত দুটি ওয়ার্ডে পিছিয়ে যায় তারা। ১১১ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর চয়ন ভট্টাচার্য এ বারও সিপিএমের প্রার্থী। লোকসভায় হারের পেছনে মোদী হাওয়ারই যুক্তি দিয়েছেন। যদিও ওয়ার্ডের একাধিক বাসিন্দার বক্তব্য, সর্দারপাড়া, ব্রহ্মপুর এলাকায় বৃষ্টি হলে এখনও জল জমে। এ বার ‘পরিবর্তন’ চাই বলে প্রচারে নেমেছেন তৃণমূলের রূপা দাস। তাঁর বক্তব্য, ‘‘পানীয় জলের অভাব রয়েছে। জলাশয়ের সৌন্দর্যায়ন হয়নি।’’ বামেদের ভোট টানতে এ সবই বলছেন বিজেপি প্রার্থী পারিজাত চন্দ। তাঁর ধারণা, ‘‘এ বার ভাল ফল করবে বিজেপি।’’ সিপিএমের চয়ন ভট্টাচার্য বলেন,‘‘কাজ কি হয়েছে, মানুষই বলবেন।’’

১৯৮৫ থেকে ১১৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সিপিএমের অমল মিত্র। সংরক্ষণের কোপে এ বার তাঁর জায়গায় প্রার্থী হিমাংশু বিশ্বাস। নতুন প্রার্থী মেনে নিয়েছেন পানীয় জলের সমস্যা রয়েই গিয়েছে। তৃণমূল প্রার্থী বিশ্বজিৎ মণ্ডলের টিপ্পনি, ‘‘৩০ বছরের বেশি একটা ওয়ার্ডে ক্ষমতায় থাকার পরেও এই হাল। এর থেকে বোঝা যায় মানুষ কি চাইছে।’’ নিউ টালিগঞ্জ, কুঁদঘাট, বন্দিপুর, আনন্দপল্লির মানুষের অভিযোগ, কলের জল সরু হয়ে পড়ে। এখনও জলের জন্য হ্যান্ড টিউবওয়েলই ভরসা।

Advertisement

কেন এই হাল? অমলবাবু বলেন, ‘‘শুধু কাউন্সিলর তহবিল দিয়েই উন্নয়নের কাজ করতে হয়েছে। তৃণমূল বোর্ড অর্থ সাহায্য করেনি।’’ কংগ্রেস প্রার্থী অতনু নস্কর ও বিজেপির প্রার্থী রঞ্জিত বিশ্বাসের দাবি, ভোটাররা এ বার সুযোগ দিলে পানীয় জলের সমস্যা মেটাতে ব্যবস্থা নেবেন।

সংরক্ষণের কোপে পড়ে এ বার দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নিজেদের ওয়ার্ড বদল করেছেন তৃণমূলের অনিতা কর মজুমদার ও গোপাল রায়। গোপালবাবুর ১১২ ওয়ার্ডে তৃণমূলের প্রার্থী অনিতাদেবী। বাসিন্দাদের অভিযোগ, উন্নয়নের কাজ হলেও পানীয় জলের সমস্যা রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা লাল্টু সরকার জানান, বৃষ্টি হলেই জল জমে। বছরভর মশার উপদ্রব। অনিতাদেবীর বক্তব্য, ‘‘নতুন জায়গা সামলাতে সময় লাগবে।’’ ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থী উমা মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমাদের হাত ছাড়া হওয়ার পরে এখানে আর উন্নয়ন হয়নি।’’ বাঁশদ্রোণির রায়নগর, নস্করপাড়া, পীরপুকুর, পালপা়ড়ার বাসিন্দাদের অভিযোগ, পানীয় জল আর নিকাশিই প্রধান সমস্যা। বিজেপি প্রার্থী দীপা চক্রবর্তী বলেন,‘‘লোকসভায় ১৫ শতাংশ ভোট পেয়েছি। এ বার আরও বাড়বে।’’ কংগ্রেস অবশ্য পিছিয়ে।

১১৩ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের প্রার্থী গোপাল রায় বলেন, ‘‘দীর্ঘ দিন অনুপস্থিত থাকায় ওয়ার্ডের কাজ গোছাতে কিছুটা সময় লাগবে।’’ বাঁশদ্রোণির রাইফেল ক্লাব, চাকদহ, জয়শ্রী, কংগ্রেস নগর এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, পানীয় জলের জন্য এখনও টিউবওয়েলই ভরসা। বর্ষায় জলবন্দি থাকতে হয়। চাকদহের বাসিন্দা বাসুদেব দাস জানান, পানীয় জল নিয়েই নিত্য ভোগান্তি। এখানে তৃণমূলের ব্যর্থতাই সিপিএমের মূল ইস্যু। প্রার্থী দীপাঞ্জন রায়ের বক্তব্য, ‘‘পানীয় জলের সমস্যা আছেই। নিকাশিও অনুন্নত।’’ বিজেপি প্রার্থী কাজল পাল ও কংগ্রেসের বিজয়কুমার রায় অবশ্য প্রচারে পিছিয়ে।

১১০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এলাকার দাপুটে সিপিএম নেতা খোকন ঘোষদস্তিদারের স্ত্রী চন্দনা ঘোষদস্তিদারকে প্রার্থী না করার সিদ্ধান্ত, সিপিএম আগেই নিয়েছিল বলে দলীয় সূত্রে খবর। যদিও চন্দনাদেবীর বক্তব্য, ‘‘আমিই দাঁড়াতে চাইনি।’’ রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, দলের শীর্ষ নেতারা আর খোকন ঘোষদস্তিদারদের মতো স্থানীয় নেতাদের মদত দিচ্ছেন না বলে প্রার্থী হতে পারেননি চন্দনাদেবী। সেখানে সিপিএমের প্রার্থী উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়। আগেও কাউন্সিলর ছিলেন তিনি। তবে টানা ১৫ বছরেরও বেশি পদে না থাকায় ওয়ার্ডের ভোটারদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন তিনি।

এই বিচ্ছিন্নতাকেই কাজে লাগাচ্ছেন তৃণমূলের তরুণ প্রার্থী তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী অরূপ চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ‘‘বিজেপির ভোট বাড়ায় লোকসভায় তাঁরা সামান্য ভোটে পিছিয়ে পড়েন। দীর্ঘ দিন সিপিএম এখানে ক্ষমতায় থাকলেও ওয়ার্ডে পানীয় জল এবং নিকাশির সমস্যা রয়েই গিয়েছে। এর সুরাহার জন্য ভোটাররা তৃণমূলকে জেতানোর ইঙ্গিত দিচ্ছেন।’’ সিপিএম ও তৃণমূলের প্রতি এখানকার বাসিন্দারা বিমুখ বলে জানান কংগ্রেস প্রার্থী উত্তম রায় ও বিজেপির প্রার্থী শ্যামল সমাদ্দার। তাই এ বার তাঁদের পাল্লা ভারি বলে মনে করছেন দু’জনেই। গত পুরভোটের দিন এখানেই নিরাপত্তারক্ষীর গুলিতে নিহত হন সিপিএমের বাপি ধর।

১০৩ নম্বর ওয়ার্ডের ‘বাম দুর্গ’ পরিচয়ের ইতি ঘটে ২০১০-এ। জয়ী হন তৃণমূলের সঞ্জয় দাস। এ বারের প্রার্থী তাঁর স্ত্রী স্বপ্না দাস। স্থানীয় বাসিন্দা দীপক চক্রবর্তীর অভিযোগ, ‘‘পানীয় জলের খুব অভাব। মশারও উপদ্রব। সংস্কার হয়নি খাল। ভিতরের রাস্তাঘাটও বেহাল।’’ এ নিয়ে সরব সিপিএম প্রার্থী নন্দিতা রায় ও কংগ্রেসের রীতা আচার্য। স্বপ্নাদেবীর কথায়, ‘‘পানীয় জলই সমস্যা। আশা করছি তা অধিকাংশ জায়গায় দিন দশেকের মধ্যেই মিটে যাবে।’’ যা
পাঁচ বছরে হল না, তা এত দ্রুত কি করে হবে? উত্তর দেননি তিনি। ওয়ার্ডের বিজেপি প্রার্থী দেবপ্রিয়া গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে দলেই ক্ষোভ রয়েছে। তিনি ‘বহিরাগত’ বলে বিজেপি কর্মীদের একাংশ প্রচারেও নামেনি।

গত লোকসভায় ১০৪ নম্বর ওয়ার্ডে আধিপত্য বজায় ছিল তৃণমূলের। প্রবল মোদী হাওয়াতেও এই ওয়ার্ডে তৃণমূলের থেকে সাড়ে ৪ হাজার ভোটে পিছিয়ে ছিল বিজেপি। এ বারও তৃণমূলের প্রার্থী স্থানীয় কাউন্সিলর তারকেশ্বর চক্রবর্তী। ওই বরোর চেয়ারম্যানও। তাঁর মূল লড়াই বাম প্রার্থীর সঙ্গেই। তবে বাম ভোটে ভাগ বসাতে লড়াইয়ে হাজির বিজেপির তাপস ধর। একসময় তৃণমূলেই ছিলেন। বছর চারেক আগে স্থানীয় নেতৃত্বের দাপটে ‘অতিষ্ঠ’ হয়েই বিজেপিতে যোগ দেন। অভিযোগ তাঁর। এ নিয়ে তৃণমূলের স্থানীয় নেতা রাহুল ঘোষ বলেন, ‘‘ওঁনার প্রোমোটারি ব্যবসা নিয়ে কিছু বিতর্ক হয়েছিল। সে কারণেই দল তাঁকে রাখতে চায়নি।’’ তাপস বলেন, ‘‘বিজেপির হয়ে লড়ছি বলে আমাদের ওঁরা আমাদের প্রচারে বাধা দিচ্ছে। ফ্লেক্স ছিঁড়ে ফেলছে।’’ এই ঝগড়ার চেয়েও পুর পরিষেবার দিকেই নজর বেশি বাসিন্দাদের। একানেও পানীয় জলের সমস্যা রয়েছে। তবে শহরের কয়েকটি ওয়ার্ডের মত এখানেও আলো, রাস্তাঘাট সাফ রাখা নিয়ে তেমন অভিযোগ নেই বাসিন্দাদের।

বিরোধী প্রার্থী আরএসপি-র পুলককৃষ্ণ মৈত্র, কংগ্রেস প্রার্থী চিরঞ্জীব দত্ত জানান, বাসিন্দারা পানীয় জল পান না। অথচ তৃণমূল পাঁচ বছর আগে বলেছিল ক্ষমতায় এলে পানীয় জলের অভাব থাকবে না। যাদবপুর পালবাজার, গড়ফা, বিবেকনগরের বাসিন্দাদের অভিযোগ রয়েছে মশার উপদ্রব নিয়েও। তারকবাবুর বক্তব্য,‘‘জল নেই এমন নয়। চাহিদার তুলনায় তা কম। গা়র্ডেনরিচের কাজ শেষ হলে আর সমস্যা থাকবে না। খালপাড়ের সৌন্দ়়র্যায়নের জন্য খালে নৌকো চালিয়ে মশা মারার কাজ
বন্ধ ছিল।’’

যাদবপুরের সন্তোষপুর থেকে রাজপুর-সোনারপুর পুরসভার লাগোয়া এলাকা হয়ে কেওড়াপুকুর খাল পর্যন্ত বিস্তৃত ১১ নম্বর বরো। টালিনালাও বয়ে গিয়েছে এখান দিয়েই। ৭টি ওয়ার্ডেই বাংলাদেশি ‘উদ্বাস্তু’ ভোটারের আধিপত্য। বহুতলের কল্যাণে অনেক এলাকায় সেই আধিপত্যে ভাগ বসাচ্ছে অবাঙালিরাও।

বরোর ১১১ থেকে ১১৪ ওয়ার্ড টালিগঞ্জ এবং বাকি ১০৩, ১০৪ এভং ১১০ যাদবপুর বিধানসভার অধীনে। দীর্ঘদিন বামেদের দখলে থাকা ১১০, ১১১ এবং ১১৪ এ বার নিজেদের দখলে আনতে মরীয়া তৃণমূল। মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের বক্তব্য, ‘‘২৫ বছর ধরে সিপিএম ওখানে রাজত্ব করেছে। অথচ এলাকায় পানীয় জল দিতে পারেনি। মাত্র সাড়ে ৩ বছরে সেই চিত্র অনেকটা বদলেছে। এখানকার মানুষের কাছে জল পৌঁছে দেওয়ায় আমাদের লক্ষ্য।’’ জবাবে ১১১ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিএমের চয়ন ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘পুর উন্নয়নের কাজে তৃণমূল বোর্ড একচোখামি করেছে। আর্থিক সহায়তা নিয়ে বিরোধী কাউন্সিলরদের ওয়ার্ডকে বঞ্চিত করেছে।’’ এ সবের জবাব ভোটেই দেবে মানুষ-এমনই আশা বামেদের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন