অধিকার থেকে বহু দূরে, ওঁদের ভরসা তাই ‘নোটা’

ভোটের আগে অবশ্য এই মানুষদের মনে পড়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের। এলাকার এক কোণে গাদাগাদি করে থাকা বৃহন্নলাদের দরজায় তখন পৌঁছে যান ভোটপ্রার্থীরা।

Advertisement

স্বাতী মল্লিক

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০১৯ ০৩:২২
Share:

বেশির ভাগ বৃহন্নলারই পেট চলে চেয়েচিন্তে। ছবি: রণজিৎ নন্দী

পুরুষালি শরীরে রঙিন শাড়ি। মুখে সস্তার মেক-আপ। ট্রেনে-বাসে-সিগন্যালে তাঁদের প্রায়ই দেখা যায় হাত পাততে। কখনও আবার তাঁরা বাড়ি বাড়ি চলে যান সদলবল। ‘পাওনা’র বিনিময়ে আশীর্বাদ করেন নবদম্পতি বা সদ্যোজাতকে। তবু সমাজের কাছে ওঁরা অচ্ছুত, অপাংক্তেয়। ওঁরা বৃহন্নলা। লিঙ্গকর্তন করা পুরুষ, যাঁরা মননে নারী।

Advertisement

ভোটের আগে অবশ্য এই মানুষদের মনে পড়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের। এলাকার এক কোণে গাদাগাদি করে থাকা বৃহন্নলাদের দরজায় তখন পৌঁছে যান ভোটপ্রার্থীরা। বলেন, ‘ভোট দিন, এটা আপনার অধিকার’। পরিবর্তে প্রার্থীদের থেকে ‘আলো-হাওয়া-জল’-এর প্রতিশ্রুতি পান এই প্রান্তবাসীরা।

আর নাগরিক পরিষেবা? শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চাকরি? হাওড়ার ডোমজুড়ের বৃহন্নলা অপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘উত্তরে প্রার্থীরা হাসপাতাল-স্কুল-কলেজ দেখিয়ে দেন! বলেন, যান না, সবই তো আছে। কিন্তু সেখানে গিয়ে যে কতটা বৈষম্যের শিকার হই আমরা, তা কেউ দেখে না।’’

Advertisement

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

রামচন্দ্রের সময় থেকে এ দেশে যে বৃহন্নলাদের অস্তিত্ব, সেই মানুষগুলি রয়েছেন এই একবিংশ শতকেও। তবে সমাজের একেবারে পিছনের সারিতে। পরিসংখ্যান বলছে, দেশে বর্তমানে প্রায় ১০ লক্ষ বৃহন্নলা রয়েছেন। এ রাজ্যে সেই সংখ্যা প্রায় তিন লক্ষ। ভোটার-আধার কার্ডে অবশ্য তাঁদের অধিকাংশের পরিচয় নারী। সামাজিক কারণে অনেকেই ভোটার কার্ডে নিজেদের লিঙ্গ পরিচয় নথিভুক্ত করাতে চান না। উল্টো দিকে, ভয়ের কারণে ওঁদের যৎপরোনাস্তি এড়িয়ে চলে সমাজও।

‘‘শুধুই কি ভয়? না কি ঘৃণাও! ‘‘আমি জানি, আমাদের মেনে নিতে এই সমাজের আরও ৫০ বছর লাগবে’’— বলছেন অপর্ণা। বৃহন্নলাদের উন্নয়নের জন্য কাজ করা অপর্ণার নিজের বৃহন্নলা হওয়ার লড়াইটা ছিল আর পাঁচ জনের মতোই। মাত্র ১৮-১৯ বছরে ঘরছাড়া। রাতের পর রাত স্টেশনে অভুক্ত কাটানোর পরে হঠাৎই যোগাযোগ হয়ে যাওয়া কোনও বৃহন্নলা-দলের সঙ্গে। তার পরে তাঁদের এক জন হয়ে যাওয়া তো নেহাত সময়ের অপেক্ষা।

বৃহন্নলাদের মাতৃতান্ত্রিক সমাজের নিয়মানুযায়ী, কোনও প্রভাবশালী বৃহন্নলাই সালিশি-বিচারের কাজ করেন। আর এলাকাভিত্তিক দল পরিচালনা করেন নায়েক বা সর্দারনি বা গুরু। তাঁর ডেরায় (বাড়ি) থাকেন তাঁর চ্যালারা। বাড়ি বাড়ি ঘুরে তাঁরা ‘পাওনা’ তুলে আনার পরে সেই টাকা ভাগ হয় সকলের মধ্যে। ফলে দারিদ্র পিছু ছাড়ে না।

পেট চালানোই যেখানে দায়, সেখানে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বিনোদন-ভাল চাকরির স্বপ্ন— সবই মরীচিকা। অপর্ণার কথায়, ‘‘প্রবাদ রয়েছে, পহেলে দর্শনধারী, ফির গুণবিচারী। আমাদের মুখ দেখলেই তো ঢুকতে দেয় না কত জায়গায়, চাকরি দেবে কী!’’ ‘নগরকীর্তন’ ছবিতে গুরুমার চরিত্রে অভিনয় করা বৃহন্নলা শঙ্করী বলছেন, ‘‘আজ যদি বাজারে আনাজও বিক্রি করতে বসি, তা হলেও কেউ আসবে না। ভাববে, আমরা হয়তো আনাজে কিছু মিশিয়ে দিয়েছি।’’ তাই আজও ‘ভিখারি’ হয়েই রয়ে যান বৃহন্নলারা। মূল স্রোতের মানুষের প্রতি এত অনাস্থা তাঁদের। ‘নগরকীর্তন’ দেখে তাই নিজেদের মধ্যে বলাবলি করেন, ‘সবাই আমাদের কত গোপন কথা জেনে গেল। এ বার পাওনা পাব তো?’

২০১৪ সালে সুপ্রিম কোর্টের ‘নালসা’ রায়ের পরেও ওঁদের অবস্থা বদলায়নি এতটুকু। ওই রায়ে রূপান্তরকামীদের জন্য সংরক্ষণের কথা বলা হলেও আজ পর্যন্ত তা রয়ে গিয়েছে খাতায়-কলমেই। ক্ষুব্ধ অপর্ণা বলছেন, ‘‘ক্যাবিনেট থেকেই না-হয় এই সংরক্ষণ শুরু হোক। মহিলাদের মতো আমাদের জন্যেও আসন নির্দিষ্ট হোক। তবেই তো বুঝব, দেশ আমাদের কথা ভাবছে।’’

নিজেদের উন্নয়নের স্বার্থে রাজনীতির ময়দানে তো বটেই, সংসদে পা রাখতে হবে কোনও ‘আপনজন’কে, তা বিলক্ষণ জানেন এই প্রান্তবাসীরা। এ-ও জানেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ সহজে তাঁদের হাতে ক্ষমতা দেবে না। তবু ভোট তাঁদের কারও কাছে উৎসব, কারও কাছে প্রহসন। গড়িয়ার বাসিন্দা শঙ্করী বলছেন, ‘‘এলাকায় দেওয়াল লিখনের সময়ে কয়েক বার সঙ্গে গিয়েছি। আমার তো বেশ লাগে।’’ উল্টো সুর অপর্ণার গলায়— ‘‘কোনও রাজনৈতিক দলের ইস্তাহারে তো আমরা থাকি না। তা হলে আমাদের ভোট পাওয়ার অধিকারও নেই। সকলে মিলে এ বার তাই ‘নোটা’য় যাব ভাবছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন