রুদ্ধ: বিজেপি সমর্থকদের মিছিলে থমকে গেল যান চলাচল। মঙ্গলবার, ধর্মতলায়। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
শহরের কাছে এমন মিছিল ‘অচেনা’।
তখন বিকেল পাঁচটা। লেনিন সরণিতে টিপু সুলতান মসজিদ পার হয়ে অমিত শাহের ছোট ট্রাক এগিয়ে গিয়েছে মিনিট দশেক হল। এরই মধ্যে নরেন্দ্র মোদীর মুখ আঁকা অতিকায় এক ট্যাবলো লরি-মিছিলের লাইন ভেঙে আগের গাড়িগুলিকে ওভারটেকের চেষ্টা শুরু করল।
মঙ্গলবারের ভরা কাজের বিকেলে রোড শোয়ের এই বিশৃঙ্খলাই বুঝিয়ে দিল, উত্তর কলকাতার ভাগ্যে কী ঝুলে আছে! খোদ মোদীর ‘ডান হাত’ অমিত শাহ এ দিন কলকাতা উত্তর কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী রাহুল সিংহের সঙ্গে একটি ছোট ট্রাকে আসীন হয়েছিলেন। সেটির পিছনে পরপর লরিতে বিজেপি-র রাজ্য নেতারা। রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ, মুকুল রায়, তারকা-সাংসদ রূপা গঙ্গোপাধ্যায়রাও ছিলেন ওই রোড শোয়ে। এই উচ্চকোটির ভিআইপি নেতাদের বলয়ে ঢুকতেই হাঁকপাঁক করছিলেন কয়েক মাস আগে তৃণমূল ছেড়ে আসা শঙ্কুদেব পণ্ডা। তাঁর ট্যাবলো-গাড়িটিও কম ঢাউস নয়। সাঁজোয়া গাড়ির বহরের মতো অজস্র গাড়ির ভিড়ে বেহাল রাজপথে এই লাইন ভাঙাভাঙি শুরু হলে যান চলাচল ব্যবস্থাটাই কার্যত ভেঙে পড়ে।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
স্বামী বিবেকানন্দের বাড়ি পর্যন্ত যাওয়ার কথা থাকলেও লেনিন সরণি, রাজা সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার, নির্মলচন্দ্র স্ট্রিট, কলেজ স্ট্রিট হয়ে অমিত শাহ বিবেকানন্দ রোডের মুখ পর্যন্ত গিয়েছিলেন। এর পরেই তাঁর রক্ষীরা গাড়ির মুখ ঘুরিয়ে দেন। রোড-শো শেষ হতে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বেজে যায়।
বিকেলে ধর্মতলার মুখে দাঁড়িয়ে হা-হুতাশ করছিলেন বিমা সংস্থার কর্মী, মধ্য পঞ্চাশের প্রৌঢ়া রেখা ভট্টাচার্য। বললেন, ‘‘বিকেল চারটে থেকে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আছি। ফিরব সল্টলেকে। যা দেখছি, অন্তত মৌলালির মোড় অবধি হাঁটা ছাড়া গতি নেই।’’ ধর্মতলার দিক থেকে শিয়ালদহমুখী যে বিপুল জনতা রোজ অফিস সেরে বেরোয়, তাদের বাড়ি ফেরার পর্ব এ দিন কার্যত ‘মহাসংগ্রামে’ পরিণত হয়েছিল।
রোড শোয়ে অতিকায় সব লরির অনেকগুলিতেই লোক ছিল কম! তা বলে রোড শোয়ের বহর নেহাত কম ছিল না। লরিতে লরিতে চলছিল ডিজে চালিয়ে নাচ-গান। রাস্তায় পোড়ানো হচ্ছিল আতসবাজি। শহিদ মিনারের কাছ থেকে বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ রোড শো শুরু হলেও কলকাতার মোড়ে মোড়ে আগেই রাস্তা আটকানোর ঘটনা ঘটে। এই জনতার অনেকেই কলকাতার রাস্তায় তত সড়গড় নন। রোড শোয়ে নিজেদের শক্তি জাহির করতে ভিন্ রাজ্য
থেকেও দলীয় সমর্থক, এমনকি প্রচার-গাড়িও নিয়ে এসেছিলেন বিজেপি নেতৃত্ব। মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানা, রাজস্থান ও অসম থেকে আসা লরিতে আরোহীদের নাচগান ও শারীরিক কসরত করতে দেখা যায়।
এর মধ্যে কাটআউট আর পোস্টার লাগানো নিয়ে তৃণমূল ও বিজেপি সমর্থকদের বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়। যার ফলে পরিস্থিতি সামাল দিতে দুপুর দেড়টা থেকে কখনও লেনিন সরণি, কখনও রাজা সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারের মুখে যান চলাচল ব্যাহত হয়। পরে রোড শো চলাকালীন কলেজ স্ট্রিট তল্লাটে তৃণমূলের ছাত্র শিবিরের সঙ্গে মিছিলের জনতার চাপান-উতোরেও বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। কলেজ স্ট্রিট বা আরও উত্তরে বিদ্যাসাগর কলেজের মুখে বিক্ষিপ্ত গোলমালের জেরে মিছিল থমকে যাওয়াতেও ভোগান্তি হয় সাধারণ মানুষের।
কাজের দিনে এ ভাবে শহরের বেহাল হওয়া রুখতে একদা ছুটির দিন ছাড়া শহরে মিটিং-মিছিল না করার কথা বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাস্তবে বিভিন্ন দল ও সংগঠনের নানা ধরনের আন্দোলন-কর্মসূচির জেরে সে কথা পুরোপুরি রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। তবু দীর্ঘদিন মিটিং-মিছিল সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত কলকাতায় বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল বা পুলিশও এক ধরনের শৃঙ্খলায় অভ্যস্ত। যে কারণে রাস্তার এক দিকে মিছিল চললেও অন্য দিকে যান চলাচল চালু রাখা সম্ভব হয়। এ দিন কিন্তু বিভিন্ন প্রচার-গাড়ি এঁকেবেঁকে পথ চলায় পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যায়। কেন রোড শো নিয়ন্ত্রণ করতে পর্যাপ্ত পুলিশের বন্দোবস্ত করা হয়নি? মিছিলের চলার পথে সর্বত্র পর্যাপ্ত পুলিশ ছিল না বলেও
অভিযোগ উঠেছে। কেন? লালবাজারের কর্তাদের কাছে এর সদুত্তর মেলেনি। কলকাতায় অনভ্যস্ত বহিরাগত জনতাকে সামলানোর কথা কি আঁচ করতে ব্যর্থ পুলিশ? অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার জাভেদ শামিম এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি।