৭২ ঘণ্টা পার, সময় থমকে ধ্বংসস্তূপেই

বাড়িতে বসে বৃহস্পতিবার সুবোধ বলেন, ‘‘মঙ্গলবার আলিপুর থেকে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। মাঝেরহাট সেতু দিয়ে যখন নামছি, আচমকা বিকট আওয়াজ হল। গাড়ি নিয়ে সোজা নীচে গিয়ে পড়লাম। জোর ঝাঁকুনি। পড়ার পরে ডান হাত প্রায় অসাড় হয়ে গেল। কোনও রকমে নামতেই দেখি চারদিকে ধুলো উড়ছে। একটু এগোতেই বুঝলাম কোমরে অসহ্য যন্ত্রণা। একটা ছেলে সিমেন্টের চাঙড়ের তলায় পড়ে রয়েছে। চারদিকে শুধু চিৎকার, আর্তনাদ।’’

Advertisement

শুভাশিস ঘটক ও দীক্ষা ভুঁইয়া

শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০২:৪৬
Share:

সুবোধ সামন্ত ও অবধেশ পাণ্ডে

তিনি যে বেঁচে আছেন, এখনও সেটাই বিশ্বাস হচ্ছে না!

Advertisement

ঘটনার প্রায় ৭২ ঘণ্টা পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু মহেশতলার আক্রা ফেরিঘাট এলাকার বাসিন্দা সুবোধ সামন্তের আতঙ্ক কাটছে না। বাড়িতে বসে বৃহস্পতিবার সুবোধ বলেন, ‘‘মঙ্গলবার আলিপুর থেকে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। মাঝেরহাট সেতু দিয়ে যখন নামছি, আচমকা বিকট আওয়াজ হল। গাড়ি নিয়ে সোজা নীচে গিয়ে পড়লাম। জোর ঝাঁকুনি। পড়ার পরে ডান হাত প্রায় অসাড় হয়ে গেল। কোনও রকমে নামতেই দেখি চারদিকে ধুলো উড়ছে। একটু এগোতেই বুঝলাম কোমরে অসহ্য যন্ত্রণা। একটা ছেলে সিমেন্টের চাঙড়ের তলায় পড়ে রয়েছে। চারদিকে শুধু চিৎকার, আর্তনাদ।’’ তিনি জানালেন, সে সময়ে চারদিকে বহু মোটরবাইক উল্টে পড়ে ছিল। বেশ কয়েক জন মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছিলেন। কয়েকটি গাড়ি দুমড়েও গিয়েছিল।

এর পরে তিনিও সাহায্য চেয়ে চিৎকার শুরু করেন, জানালেন সুবোধবাবু। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘চার দিক থেকে লোকে ছুটে আসছিলেন। মোবাইলে ছবি তুলছিলেন। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসছিলেন না।’’ কিছু ক্ষণ পরে মেট্রোর কয়েক জন শ্রমিক এগিয়ে যান। তার পরে পুলিশ। সুবোধ দাঁড়াতে পারছিলেন না। তাই কোনওমতে একটু এগিয়ে আবার রাস্তায় বসে পড়েন। পেশায় ব্যবসায়ী সুবোধ জানান, এর কিছু পরে পুলিশ আসতে থাকে। একে একে জখমদের তোলার কাজ শুরু হয়। সুবোধ বলেন, ‘‘আমার নজর ছিল সিমেন্টের চাঙড়ের তলায় ওই ছেলেটির দিকে। হাত-পা নাড়ছিলেন। ওঁকে উদ্ধারও করা হল। পরে শুনলাম, ওঁর মৃত্যু হয়েছে।’’

Advertisement

তাঁকেও হাসপাতালে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন পুলিশকর্মীরা। তত ক্ষণে তিনি খবর দিয়েছেন বাড়িতে। তাঁকে নিতে চলে আসেন ছেলে ও শ্যালক। এ দিন তাঁর ছেলে সম্বুদ্ধ বলেন, ‘‘কোনও রকমে বাবাকে অন্য গাড়িতে তুলে নিয়ে আসি আমরা।’’ যে গাড়িটা চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি, সেটি আলিপুর থানায় রাখা আছে। এ দিন তাঁর বাড়ি গিয়ে দেখা গেল, আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে পারছে না তাঁর পরিবারও। সুবোধবাবুর স্ত্রী শাশ্বতী বলেন, ‘‘বড় বিপদ থেকে বেঁচে ফিরেছে। শুনেছি ওখানে পড়েছিলেন যাঁরা, কম-বেশি জখম হয়েছেন সকলেই। ও জখম না হলেও চিকিৎসক কটা দিন বিশ্রাম নিতে বলেছেন।’’

আরও পড়ুন: রেলিং থেকে পথ, জরাজীর্ণ সবই

সেতুর ধ্বংসস্তূপের মাঝেই পাসপোর্ট আর ড্রাইভিং লাইসেন্স রয়ে গিয়েছে দুর্ঘটনায় কোনওমতে প্রাণে বেঁচে যাওয়া আর এক জনের। আতঙ্ক জয় করেই তাই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে সে সব খুঁজে চলেছেন অবধেশ পাণ্ডে। বছর বত্রিশের অবধেশ জোকা-বি বা দী বাগ মেট্রোর কাজে যুক্ত। মঙ্গলবার যখন সেতু ভেঙে পড়ল, তার তলায় আটকে পড়েছিলেন তিনিও। জানালেন, আগের রাতে ডিউটি করে দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে সেতুর নীচে অস্থায়ী ঘরে শুয়ে মোবাইলে সিনেমা দেখছিলেন। আচমকা বাজ পড়ার মতো আওয়াজে চমকে ওঠেন। বৃহস্পতিবার দুপুরে অবধেশ বলেন, ‘‘প্রাণে বেঁচেছি, এটাই অনেক। আমার সঙ্গে ছিলেন গুরুপদ জানা। তাঁকে ঠেলে বার করে দিই। কিন্তু আমার চেহারা ভারী বলে আটকে গিয়েছিলাম। পরে দু’জন পা ধরে টেনে-হিঁচ়়ড়ে আমাকে বার করে আনেন।’’ তবে কোনও রকমে প্রাণে বাঁচলেও হারিয়েছেন ব্যাগ-সহ যাবতীয় জিনিসপত্র। তিনি জানালেন, আপাতত দিন চলছে কয়েক জন পরিচিতের সাহায্যে। কোনও টাকা-পয়সাও নেই তাঁর কাছে। মোবাইলটিও গিয়েছে স্তূপের তলায়। অন্য এক জনের মোবাইল নিয়ে উত্তরপ্রদেশের ফৈজাবাদে নিজের বাড়িতে শুধু জানিয়েছেন, তিনি বেঁচে আছেন।

(শহরের প্রতি মুহূর্তের সেরা বাংলা খবর জানতে পড়ুন আমাদের কলকাতা বিভাগ।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন