প্রেসিডেন্সি: ১৫০ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রীর

অনুদানের দিনেই বিক্ষোভ পড়ুয়াদের

প্রথমবার পা রেখেই প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ১৫০ কোটি টাকারও বেশি অনুদান ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর এই প্রথম সরাসরি ছাত্র বিক্ষোভের আঁচ পেলেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পরে পুলিশি নির্যাতনের অভিযোগ তুলে উপাচার্যকে ঘেরাও করেন একদল ছাত্রছাত্রী। ঘেরাও চলে গভীর রাত পর্যন্ত।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০১৫ ০৩:০২
Share:

উপাচার্য অনুরাধা লোহিয়ার সামনে তাণ্ডব পড়ুয়াদের। শুক্রবার বিশ্বনাথ বণিকের তোলা ছবি।

প্রথমবার পা রেখেই প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ১৫০ কোটি টাকারও বেশি অনুদান ঘোষণা করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর এই প্রথম সরাসরি ছাত্র বিক্ষোভের আঁচ পেলেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পরে পুলিশি নির্যাতনের অভিযোগ তুলে উপাচার্যকে ঘেরাও করেন একদল ছাত্রছাত্রী। ঘেরাও চলে গভীর রাত পর্যন্ত।

Advertisement

গত বছর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বিক্ষোভ থামাতে নিজেই সেখানে গিয়েছিলেন মমতা। আর এ দিন প্রেসিডেন্সিতে মমতার আগমন ঘিরেই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিক্ষোভ দানা বেঁধেছিল। মূলত ২০১২ সালের ১০ জুলাই প্রেসিডেন্সিতে পড়ুয়াদের ওপর হামলার ঘটনায় কেউ গ্রেফতার না হওয়ায় মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রীর বিরুদ্ধে পোস্টার পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে।

মমতা অবশ্য এ দিনের এই পোস্টার প্রদর্শন, স্লোগান, বিক্ষোভকে আমলই দেননি। ডিরোজিও হলে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, ‘‘আমাকে এক জন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কি প্রেসিডেন্সি যাচ্ছেন?’ আমি বললাম, কেন যাব না? কথা দিয়েছি, অফকোর্স যাব। যাদবপুরে যখন সমস্যা হয়েছিল, ওরা ডাকেনি, আমি অনাহুত হয়েই গিয়েছি। আমি যেখানে প্রয়োজন মনে করি, যাই।’’ এখানেই তিনি থামেননি। বলেছেন, ‘‘গণতন্ত্রে সৌজন্য বলে একটা কথা আছে। আমি যেমন সেটা মানি, অন্যদেরও মানতে হবে।’’

Advertisement

এর পরেই প্রেসিডেন্সির জন্য অনুদানের ঝাঁপি খুলে দেন মমতা। কী ছিল সেই ঝাঁপিতে? নিউ টাউনে প্রেসিডেন্সির নতুন ক্যাম্পাসের জন্য ১১৮ কোটি (তার মধ্যে মঞ্চেই উপাচার্য অনুরাধা লোহিয়ার হাতে মমতা দিলেন ৩০ কোটির চেক), বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরামতি, সংস্কার ও সৌন্দর্যায়নে ১০ কোটি, প্রেসিডেন্সির গ্রন্থাগারের উন্নতিকল্পে ১ কোটি ৭৮ লক্ষ, কার্সিয়াংয়ের ডাও হিলে ১০০ একর জমিতে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের হিমালয়ান সেন্টার তৈরির জন্য ৩০ কোটি। এখানেই শেষ নয়। প্রেসিডেন্সির অনুষ্ঠানের পরে ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে অন্য একটি অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন মমতা। সেখানে স্থানীয় তৃণমূল সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে তাঁর সাংসদ তহবিল থেকে ১ কোটি টাকা প্রেসিডেন্সি ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে ভাগ (প্রত্যেককে ৫০ লক্ষ) করে দিতে নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।

প্রেসিডেন্সির আমন্ত্রণে তিনি যে আপ্লুত, তা ডিরোজিও হলে মমতার বক্তৃতাতেই স্পষ্ট। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘আপনাদের ঐতিহ্যময় ঘরানায় আসার সুযোগ করে দিয়েছেন, আপনাদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন— এটা একটা বড় পাওনা। যে ভালবাসার আঁচল উপহার দিয়েছেন, তা আমার মনে থাকবে।’’ তার আগে অনুরাধাদেবীও বলেন, ‘‘এই প্রথম আমাদের এখানে পা রাখলেন, আমরা অভিভূত। আপনি শুধু মুখ্যমন্ত্রী নন, যুবাপ্রজন্ম ও সমাজের জন্য এক প্রেরণা।’’

এই প্রশংসা এবং অভিনন্দনের বাতাবরণের অন্য পিঠে প্রেসিডেন্সি এ দিন ছিল মমতা বিরোধী স্লোগান ও পোস্টারে উত্তাল। মুখ্যমন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলে যাওয়ার পরে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গাড়ি বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে ঢোকা মাত্র স্লোগান দিতে শুরু করেন পড়ুয়ারা। মন্ত্রীর গাড়ি থেমে যায়।

পরে পোর্টিকোর ভিতর দিয়ে না গিয়ে পাশের রাস্তা দিয়ে ঘুরিয়ে গাড়ি ঢোকে।

কিন্তু মমতার গাড়ি ঢোকার সময় বুঝতে পারেননি বিক্ষোভকারীরা। বুঝতে পেরেই মুখ্যমন্ত্রীর গাড়ির দিকে দৌড়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন অনেকে। পুলিশ বাধা দেয়। পুলিশের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয় ছাত্রদের। সঙ্গে-সঙ্গে ছাত্ররা অভিযোগ জানাতে থাকে যে, পুলিশ তাঁদের গায়ে হাত তুলেছে। পুলিশের শাস্তির দাবিতে এ বার তাঁদের বিক্ষোভ অবস্থান শুরু হয় বেকার হলের সামনে। উদ্বিগ্ন পুলিশ যখন মুখ্যমন্ত্রীকে কী ভাবে অনুষ্ঠানের শেষে প্রেসিডেন্সির বাইরে নিয়ে যাওয়া যায় সেই জল্পনা করছেন, এমন সময় মমতা অনুষ্ঠান সেরে বাইরে বেরিয়ে আসেন। জোরে হাঁটতে শুরু করেন প্রেসিডেন্সির মাঠ দিয়ে। মাঠ পার হয়ে প্রেসিডেন্সি চত্বর ছেড়ে হেঁটে হেঁটেই তিনি চলে যান কলেজ স্কোয়ারের অন্য দিকে, ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে। মুখ্যমন্ত্রীর পরের অনুষ্ঠান ছিল সেখানেই।

প্রেসিডেন্সিতে তখন পড়ুয়ারা ঘেরাও করেছেন উপাচার্যকে। তাঁদের অভিযোগ, পুলিশ তাঁদের উপর লাঠি চালিয়েছে। তাঁরা উপাচার্যের পদত্যাগ দাবি করেন। অনুরাধাদেবী বলেন, ‘‘সে দিনই পদত্যাগ করব, যে দিন আমি ভুল করব। কোনও ভুল করিনি, তাই পদত্যাগের প্রশ্নই ওঠে না।’’

এর মধ্যেই প্রেসিডেন্সির ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে এসে যোগ দেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘হোক কলরব’ আন্দোলনের অনেক সদস্যই। উপাচার্যের পাশে বসা রেজিস্ট্রারকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতে দেখা যায় বিক্ষোভকারীদের। কেউ কেউ সিগারেট ধরিয়ে উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের মুখে ধোঁয়া ছাড়তে থাকেন। আজ, শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় সমাবর্তন অনুষ্ঠান। কর্তৃপক্ষ ঘেরাও তুলে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু পড়ুয়ারা সে কথায় কোনও কান দেননি। উপাচার্য অনুরাধা লোহিয়া বলেন, ‘‘আমি উচ্চশিক্ষা দফতরকে অনুরোধ করব, ছাত্রছাত্রীদের অভিযোগের ব্যাপারে তদন্ত করতে। যদি মারধরের ঘটনা ঘটে থাকে, তা দুঃখজনক। তবে ভিড়ের মধ্যে যদি কিছু হয়ে থাকে সেটা তো আমার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়।’’

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, পুলিশ লাঠি হাতে দৌড়োদৌড়ি করলেও, ছাত্রছাত্রীদের উপরে তারা লাঠি চালায়নি। এই দাবি পুলিশেরও। নবান্ন সূত্রের খবর, যে ভাবে ছাত্রছাত্রীরা মমতা বেরিয়ে যাওয়ার পরে উপাচার্যকে ঘেরাও করে রেখেছেন তাতে রাজ্য সরকার ক্ষুব্ধ। ঘেরাও তুলতে উপাচার্য যে কোনও সাহায্য চাইলেই তা দেওয়া হবে বলেও অনুরাধাদেবীর কাছে বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়। তবে উপাচার্য বলেছেন, ‘‘যতক্ষণ ঘেরাও চলবে আমি আমার চেয়ারেই বসে থাকব।’’

এ দিনের বিক্ষোভের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রেসিডেন্সির শিক্ষক এবং প্রাক্তনীরা অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। এক শিক্ষকের কথায়, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয় স্বশাসিত সংস্থা। মুখ্যমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রীকে ঘিরে বিক্ষোভ কেন?’’ এক প্রাক্তনীর মন্তব্য, ‘‘বিশ্ববিদ্যালয় যাতে ঠিকঠাক চলে তার জন্য রাজ্য সরকার উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গড়ে দিয়েছে। আর তো কিছু করার নেই!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন