‘আমিও তো বাবা, মায়া পড়ে গিয়েছে’

কাচের ঘরে শুয়ে থাকা তিন দিন বয়সী শিশুটির পাশে নিজের বলতে কেউ নেই। চিকিৎসক, নার্স আর যিনি হাসপাতালে ভর্তি করেছিলেন, তাঁরাই এখন আপন হয়ে উঠেছেন।

Advertisement

শান্তনু ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ মে ২০১৯ ০১:৩২
Share:

মানবিক: উদ্ধার হওয়া শিশুকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন অটোচালক রতন কর। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়

আপাতত তার ঠিকানা, আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ‘নিওনেটাল ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিট’ (নিকু)। পরিচিতি বলতে ‘নিকু ৪২’।

Advertisement

কাচের ঘরে শুয়ে থাকা তিন দিন বয়সী শিশুটির পাশে নিজের বলতে কেউ নেই। চিকিৎসক, নার্স আর যিনি হাসপাতালে ভর্তি করেছিলেন, তাঁরাই এখন আপন হয়ে উঠেছেন। গত শনিবার সকালে বরাহনগরের ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে এ কে মুখার্জি রোডের একটি জঞ্জালের স্তূপ থেকে পাওয়া গিয়েছিল প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরা ওই সদ্যোজাত পুত্রকে।

উদ্ধারের পরে শিশুটির পেট ওঠানামা করতে দেখে তাকে নিয়ে বরাহনগর স্টেট জেনারেল হাসপাতালে ছুটেছিলেন এলাকারই বাসিন্দা, পেশায় অটোচালক রতন কর। তিনি এখনও নিয়ম করে প্রতিদিন বিকেলে যাচ্ছেন হাসপাতালে। এক ছেলে ও এক মেয়ের বাবা রতনবাবু বলেন, ‘‘আমিও তো বাবা, মায়া পড়ে গিয়েছে। এতটুকু একটা শিশুকে আবর্জনার মধ্যে ফেলে দিয়ে গেল! কেউ এতটা অমানবিক কী করে হয়? ওকে উদ্ধারের পরে হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়েই তো দায়মুক্ত হতে পারি না।’’ শুধু প্রতিদিন গিয়ে শিশুটিকে দেখে আসাই নয়, তার প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রও কিনে দিচ্ছেন রতনবাবু।

Advertisement

হাসপাতাল সূত্রের খবর, শিশুটি এখন সুস্থ। মাথায় চোট আছে বলে সন্দেহ করা হয়েছিল। তবে সিটি স্ক্যান করে তেমন কিছু মেলেনি। শ্বাসকষ্ট রয়েছে এখনও। কারণ, দু’টি প্লাস্টিকের ব্যাগের ভিতরে ভরা ছিল শিশুটি। তাতেই শ্বাস নেওয়ার ক্ষেত্রে একটা সমস্যা তৈরি হয়েছে। সোমবার রতনবাবু বলেন, ‘‘দুটো প্লাস্টিকের ভিতরে মুড়ে এত ক্ষণ ফেলে রাখলে তো শ্বাস নিতে সমস্যা হবেই। তবে সুস্থ হয়ে ওর ঠিকানা কী হবে, সেটাই চিন্তার।’’

উদ্ধার হওয়া শিশু। নিজস্ব চিত্র

নাম-পরিচয়হীন শিশুটিকে নতুন ঠিকানা দিতে এখন অনেকেই ভিড় করছেন রতনবাবুর বাড়িতে। কেউ আবার তাঁকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাচ্ছেন হাসপাতালে। রতনবাবুর কথায়, ‘‘সকলেই এসে বলছেন, বাচ্চাটা আমাকে দিন। কিন্তু আমি তো দেওয়ার মালিক নই। এক জন মহিলা তো আমাকে গাড়িতে উঠিয়ে হাসপাতালেও গেলেন শিশুটিকে দেখতে। কিন্তু সব সময়ে তো নিকু-তে যেতে দেওয়া হয় না। তাই উনি দেখতে পারেননি।’’

সন্তানহীন অনেক দম্পতি আবার যাচ্ছেন বরাহনগর হাসপাতালের সুপার জয়ব্রতী মুখোপাধ্যায় ও স্থানীয় কাউন্সিলর অঞ্জন পালের কাছে। জয়ব্রতী বলেন, ‘‘অনেকেই এসে বলছেন, টাকা লাগলে দেব।

শুধু বাচ্চাটাকে পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিন। সকলকেই বোঝাচ্ছি, সরকারি নিয়ম মেনে বাচ্চা দত্তক নিতে হয়। তাই আমার কিছু করার নেই।’’ রবিবার অনেকে বরাহনগরে ভোট দিতে এসে পাকড়াও করেছেন অঞ্জনকে। কেউ শিশুটির শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিয়েছেন। কেউ আবার শিশুটিকে পাইয়ে দিতে অনুরোধ করেছেন।

প্রশাসনিক আধিকারিকেরা অবশ্য জানিয়েছেন, শিশুটিকে কোনও ভাবেই কারও হাতে দেওয়া সম্ভব নয়। তাঁরা জানাচ্ছেন, সুস্থ হওয়ার পরে হাসপাতাল থেকে শিশুটিকে চাইল্ড লাইন নিয়ে যাবে শিশু কল্যাণ সমিতির কাছে। তাদের নির্দেশ পেলে, যে হোমে সদ্যোজাতদের রাখা হয়, সেখানেই ঠাঁই হবে ওই শিশুটির। এর পরে সংবাদপত্রে ওই শিশুটির সম্পর্কে একটি বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে।

দু’মাসের মধ্যে যদি বাবা-মা কিংবা পরিবারের কেউ সমস্ত তথ্যপ্রমাণ-সহ তাকে নিতে না আসেন, তা হলে শিশুটিকে দত্তক কেন্দ্রে পাঠানো হবে। এর পরে সরকারি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে অনলাইনে আবেদন করে যে ভাবে দত্তক নেওয়া হয়, সে ভাবেই ভাগ্য নির্ধারণ হবে ‘নিকু ৪২’-এর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন