নতুন বছরে ঐতিহ্যের সম্মান দিক শহর!

গুরু নানক সরণি ও ডাফরিন রোডের সংযোগস্থলে গাঁধী মূর্তির নীচে বসে কথাগুলো বলছিলেন পূর্ত দফতরের অধীনস্থ এক ঠিকাদারি সংস্থার ওই কর্মী। জানালেন, মহাত্মা গাঁধীর মূর্তি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব তাঁরই।

Advertisement

দেবাশিস ঘড়াই

শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০১৯ ০১:১৮
Share:

অবহেলায়: এ শহরে এ ভাবেই মলিন হয়ে পড়ে মনীষীদের বহু মূর্তি। (১) লেনিন এবং (২) মধুসূদন দত্তের মূর্তির গায়ে পাখির বিষ্ঠা। (৩) ধুলো পড়ে মলিন মাতঙ্গিনী হাজরার মূর্তি। (৪) রাসবিহারী বসুর মূর্তির পাশে ঝুলছে জামাকাপড়। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

লাঠির মাথায় কাপড় বাঁধছিলেন ভদ্রলোক। দড়ি দিয়ে কাপড়টা বাঁধার পর বললেন, ‘‘পাখি তাড়ানোর জন্য। নইলে তো সব নোংরা করে দেয়।’’

Advertisement

গুরু নানক সরণি ও ডাফরিন রোডের সংযোগস্থলে গাঁধী মূর্তির নীচে বসে কথাগুলো বলছিলেন পূর্ত দফতরের অধীনস্থ এক ঠিকাদারি সংস্থার ওই কর্মী। জানালেন, মহাত্মা গাঁধীর মূর্তি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব তাঁরই। অনেক সময় রাসায়নিক ব্যবহার করতে হয়। কারণ, জলে সব সময় পাখির বিষ্ঠা যায় না।

ওই ভদ্রলোক যেখানে বসে এই কথা বলছিলেন, তার কিছুটা দূরেই রেড রোড বরাবর একের পর এক মূর্তি।—মাতঙ্গিনী হাজরা, মাইকেল মধুসূদন দত্ত। আরও কিছুটা দূরে আকাশবাণী ভবনের সামনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ বা এসপ্ল্যানেড ম্যানসনের বিপরীতে বিপ্লবী রাসবিহারী বসু বা এসপ্ল্যানেডের লেনিন মূর্তি। সেইসব মূর্তির কোনওটার মাথায়, কোনওটার নাকের পাশ দিয়ে পাখির বিষ্ঠা নামার সেই চিরাচরিত দৃশ্য।

Advertisement

সে দৃশ্য দেখে অবশ্য বোঝার উপায় নেই এ শহরের ২৬টি মূর্তি হেরিটেজ তালিকায় সর্বোচ্চ মর্যাদাপ্রাপ্ত অর্থাৎ গ্রেড ওয়ান তালিকাভুক্ত!

অথচ শিল্পী কমল সরকারের লেখা ‘কলকাতার স্ট্যাচু’ বইটি থেকে জানা যায়, মূর্তির সঙ্গে এ শহরের সম্পর্ক সুগভীর ও সুপ্রাচীন। তিনি লিখছেন, ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে ইংরেজরাই প্রতিষ্ঠা করেছিল শহর কলকাতার প্রথম প্রতিমূর্তি।...ফোর্ট উইলিয়ামের গভর্নর-জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিসের ওই মূর্তি দিয়েই শহর কলকাতার প্রকাশ্য স্থানে খ্যাতনামা ব্যক্তিদের মূর্তি প্রতিষ্ঠার সূচনা।’

সেই শুরু! সুরেন্দ্রনাথ উদ্যানে (কার্জন পার্ক) রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মূর্তি বসানোর দিন, ১৯৪১ সালের ৩১ অগস্ট আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখা হয়, ‘স্যার সুরেন্দ্রনাথের প্রতিমূর্তি প্রস্তুত করিতে প্রায় ৩০ হাজার টাকা ব্যয় হইয়াছে। খ্যাতনামা বাঙালী চিত্রশিল্পী ও মাদ্রাজের সরকারী চিত্রবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ শ্রীযুক্ত দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরীকে প্রতিমূর্তি প্রস্তুত করিবার ভার দেওয়া হয়।’

বা মাইকেল মধুসূদনের মূর্তি। আশির দশক পর্যন্ত ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এর রচয়িতার কোনও পূর্ণাঙ্গ মূর্তি ছিল না। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের মন্ত্রিসভার আমলে মাইকেলের মূর্তি প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৮২ সালের ৯ অক্টোবর রেড রোডে বসানো মাইকেলের পূর্ণাঙ্গ মূর্তিটির আবরণ উন্মোচন করেন অভিনেতা উৎপল দত্ত। সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মাইকেলের বংশধরদের অনেকেই।

আবার রেড রোডের পশ্চিমদিকে ময়দানের মধ্যে শিল্পী কার্তিকচন্দ্র পালের তৈরি বি.আর অম্বেদকরের যে মূর্তিটি রয়েছে, ১৯৮৫ সালের ৪ অগস্ট সেটির উদ্বোধন করেছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জ্ঞানী জৈল সিং। সভার সভাপতিত্ব করেছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। সেদিন দু’জনেরই বক্তৃতায় উঠে এসেছিল শ্রেণীবৈষম্য ও জাতপাত-ভেদাভেদের কথা।

মূর্তির ইতিহাসের সঙ্গে এভাবেই মিলেমিশে গিয়েছে শহরের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-সামাজিক ইতিহাস। কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রকের অধীনস্থ ‘ন্যাশনাল গ্যালারি অব মডার্ন আর্ট’-এর ডিরেক্টর জেনারেল অদ্বৈত চরণ গদনায়ক বলেন, ‘‘এই ধরনের ভাস্কর্য আমাদের ইতিহাসের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। তবে এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ ঠিকমতো হয় না।’’ অথচ অনেক শহরেই মূর্তি পরিষ্কারের জন্য স্থায়ী সিঁড়ি রয়েছে। এখানে মূর্তি পরিষ্কার অস্থায়ী মই বা ধাতব সিঁড়ি নির্ভর, তা-ও নিয়মিত নয়।

শুধু কী মূর্তি! কলকাতা পুরসভার হেরিটেজ তালিকার দিকে তাকালে সম্ভ্রম জাগতে বাধ্য। কারণ, শহরে গ্রেড টুএ ও গ্রেড টুবি মর্যাদাপ্রাপ্ত হেরিটেজ ভবনের সংখ্যা যথাক্রমে ১৯৫ ও ১০৫টি এবং ‘গ্রেড পেন্ডিং’ ভবনের সংখ্যা ৭৫টি। সেখানে গ্রেড ওয়ান মর্যাদাপ্রাপ্ত ঐতিহ্যশালী ভবনের সংখ্যা ৬১২টি!

অথচ ঐতিহ্যের এই বিপুল গরিমার পরেও এ শহরেই গ্রেডের অবনমন ঘটিয়ে চোখের সামনে ভেঙে ফেলা যায় ২২৫ বছরের পুরনো হোটেল, কোথাও হাতবদল হয়ে যায় পুরনো বাড়ির। হেরিটেজ স্থপতি হিমাদ্রি গুহ কিছুটা আক্ষেপ করেই বলছেন, ‘‘গ্রেড ওয়ান হেরিটেজ শুধুমাত্র পুরসভার তালিকায় থাকলেই হবে। ঐতিহ্য রক্ষার দায় আর কে নেয়!’’

সত্যিই। বিগত বছরগুলিতে সেই দায়িত্ব নিতে কাউকে দেখা যায়নি। শুধু ‘কলকাতাকে হেরিটেজ শহর হিসেবে ঘোষণা করা উচিত’,— বিক্ষিপ্ত ভাবে কয়েক জায়গায় এই দাবিটুকু ওঠা ছাড়া। অথচ এই শহরই অতীতে শিখিয়েছে পুরনো ভবনকে ইট-পাথরের নির্মাণের বাইরে বেরিয়ে তার ঐতিহ্যকে সম্মান দিতে, মূর্তির সঙ্গে এক জনপদের ইতিহাসকে অঙ্গাঙ্গী ভাবে মিশিয়ে দিতে। কিন্তু সে সব শিক্ষাই এখন বিস্মৃতপ্রায়। তাই অন্তঃসারশূন্য গরিমা নয়, প্রাপ্য সম্মানটুকু পাক ঐতিহ্য!—এমনটাই চাইছেন হেরিটেজ বিশেষজ্ঞ থেকে শহরের ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন সাধারণ মানুষও। ২০১৯-এর কলকাতা কি ফিরিয়ে দিতে পারবে সে সম্মান? শহরের ঐতিহ্যকে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন