দালালদের খপ্পর থেকে রোগী ও পরিজনদের দূরে রাখতে এ ভাবেই সতর্ক করার চেষ্টা এসএসকেএম হাসপাতালে। — নিজস্ব চিত্র
এক হাতে কাগজের কাপে ধোঁয়া ওঠা চা। অন্য হাতে টুকরো কাগজের গোছা। তাতে নাকি বিভিন্ন রোগীর ‘রেফারেন্স’ লেখা আছে! চায়ে শেষ চুমুকটা দিয়ে তিনি বললেন, ‘‘আমরা হলাম রক্তবীজের ঝাড়, বুঝলেন! এক জনকে ধরবে, তো আরও হাজার জন বেরিয়ে আসবে।’’
মঙ্গলবার বেলা ১১টা। এসএসকেএম হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিভাগের অদূরে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল যাঁর সঙ্গে, তাঁর দাবি প্রতিদিন তাঁর মাধ্যমেই নাকি অন্তত ১০-১২ জন রোগী ভর্তি হন। ব্লাড ব্যাঙ্ক ‘নেই’ বলে দেওয়ার পরেও চার-পাঁচ ইউনিট বিরল গ্রুপের রক্তের ব্যবস্থা হয়ে যায়। এবং অস্ত্রোপচারের ডেট হু হু করে এগিয়ে আসে। এসএসকেএমের মেডিসিন, সার্জারি এবং কার্ডিওলজি বিভাগে তাঁর অবাধ যাতায়াত। আর দাবি— হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্তা থেকে শুরু করে ডাক্তার, নার্স, টেকনিশিয়ান— সকলেই তাঁকে চেনে।
দোহারা চেহারা। পরনে ট্রাউজার্স আর ফতুয়া। বুক পকেটে খানতিনেক পেন গোঁজা। অহরহ মোবাইল বাজছে। নাম গোপন রাখার শর্তে এ দিন সকালে কথা বলতে রাজি হয়েছিলেন এসএসকেএমের এই চতুর্থ শ্রেণির কর্মী। হাসপাতালের বিভিন্ন মহলে যোগাযোগ করে এঁর হদিস মিলেছিল সোমবার রাতেই। উদ্দেশ্য ছিল— কোন অদৃশ্য ক্ষমতার বলে বার বার পুলিশি অভিযান সত্ত্বেও দালালরাজ অব্যহত ওই হাসপাতালে, তারই খানিকটা আঁচ পাওয়া।
রোগীকল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পাওয়ার পরে মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস এসএসকেএমে দালালরাজ হটাতে কড়া পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করেছেন একাধিক বার। হাসপাতালের সুপার করবী বড়ালও জানিয়েছেন, পুলিশের সঙ্গে যৌথ ভাবেই তাঁরা দালালচক্র নির্মূল করার চেষ্টা করছেন। রাতবিরেতে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে হাসপাতালে। স্বাভাবিক ভাবে এমন একটা পরিস্থিতিতে অন্তত কিছু দিনের জন্য দালালচক্রের অস্তিত্ব টের পাওয়া যাবে না, এমনটাই মনে করেছিলেন সকলে।
বাস্তবে দেখা গেল, প্রায় প্রতিদিনই দালালদের হাতে টাকা খোয়ানোর অভিযোগ জমা পড়ছে। অথচ গত এক মাসে ১৭ জন দালাল ধরা পড়েছেন। এর মধ্যে গত ৪৮ ঘণ্টাতেই ধরা গিয়েছে চার জনকে। তা হলে কি প্রশাসনিক এই তৎপরতায় দালালদের কোনও হেলদোলই নেই? কীসের জোরে এতটা বেপরোয়া থাকতে পারছেন তাঁরা?
এই প্রশ্নের উত্তরেই হাসপাতালের ওই দালাল ‘দাদা’ রক্তবীজের কথাটা তুললেন। তাঁর দাবি, প্রত্যেক বিভাগেই এমন একাধিক দালাল রয়েছেন। প্রশাসনের কর্তারাও তাঁদের অস্তিত্ব সম্পর্কে বিলক্ষণ ওয়াকিবহাল। কারণ তাঁরা না থাকলে নাকি ‘ক্যাচ’-এর পেশেন্ট ভর্তি করতেও বেগ পেতে হবে নেতাদের। কোথায়, কত বেড খালি থাকে— তা তাঁদেরই নখদর্পণে। ‘‘সব ওয়ার্ডেই আমাদের প্রভাব আছে। নেতারা যখন হাসপাতালের কর্তাদের ফোন করে অমুক বিভাগে তমুক পেশেন্টকে ভর্তি করার কথা বলেন, তখন অনেক সময়ে সেই কর্তারাও থই পান না। অনেক সময়ে তাঁদের ফোনেও ওয়ার্ডের ডাক্তার-নার্সরা জানিয়ে দেন, জায়গা নেই। তখন তাঁরা বহু ক্ষেত্রে আমাদেরই বলেন, ‘দ্যাখ তো, কী ভাবে ম্যানেজ করা যায়। আমরা তো তখনও ‘ম্যানেজ’ করি,’’ সগর্বে বলছেন ‘দাদা’।
তা হলে কি সরাসরি প্রশাসনিক কর্তাদের দিকেই আঙুল তুলছেন? তাঁর জবাব, ‘‘না, আঙুল কেন তুলব? একটা কথাই বলতে চাইছি, আমাদের অস্তিত্ব কেউ জানেন না, তা নয়। হাসপাতালের কর্তারা জানেন। রাজনৈতিক নেতারাও জানেন। অবশ্য তাঁদের কাজ করে দেওয়ার জন্য আমরা কোনও ফি নিই না।’’ প্রশাসনিক কর্তারা অবশ্য আঙুল তুলছেন ডাক্তারদের একাংশের দিকেই। তাঁদের বক্তব্য, নিখরচায় যে পরিষেবাগুলি পাওয়ার কথা, তার বিনিময়ে কোনও কোনও ডাক্তারের পকেট ভরছে— এমন অভিযোগও পাচ্ছেন তাঁরা। ওই কর্তাদের দাবি, চতুর্থ শ্রেণির কর্মীদের চিহ্নিত করা তবু সহজ, ডাক্তারদের ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া মুশকিল।
দালাল-রাজের ছবিটা ঠিক কী রকম?
‘দাদা’ জানান, রোগী ভর্তি করার জন্য তাঁদের নির্দিষ্ট রেট আছে। জেনারেল বেড হলে রেট কম। এককালীন কিছু টাকা নেন। আইটিইউ, সিসিইউ-এ রেট অনেক বেশি। ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা করতে পারলে তো আরও ভাল। ‘‘যে লোকটা তার রোগীর জন্য প্রাইভেট হসপিটালে প্রতিদিন আইটিইউ-য়ে ৩০ হাজার টাকা করে খরচ করছে, তাকে যদি আমি এখানে ভর্তির ব্যবস্থা করে দিই, তা হলে তো সবটাই ফ্রি। তা হলে যদি সে প্রতিদিন দু’হাজার করেও দেয়, তাতেও তো তার ২৮ হাজার টাকা করে বাঁচছে। বুঝলেন তো?’’ প্রশ্ন করলেন তিনি।
বোঝা গেল বিলক্ষণ। বহিরাগত দালাল নয়। প্রাতিষ্ঠানিক দালালরাই রাজত্ব চালাচ্ছে এসএসকেএমের মতো মেডিক্যাল কলেজগুলোতে। কখনও তাঁরা সামনে আসছেন। কখনও বা বহিরাগতদের সামনে রেখে নেপথ্য থেকে কাজটা করছেন। এঁরা অনেকেই হাসপাতালেরই তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণির কর্মী। হাসপাতালের সর্বত্র তাঁদের অবাধ গতিবিধি এবং পরিচিতি। তার সঙ্গে মিলে যায় রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়া। সব মিলিয়ে দুর্দান্ত ‘প্যাকেজ’!
কী বলছেন সুপার করবী বড়াল? তাঁর জবাব, ‘‘চেষ্টা তো করেই চলেছি। তার পরেও এই ফলাফল খুব হতাশ করছে। এদের যোগাযোগটা এতটাই গভীরে যে, তল পেতে পেতে হয়রান হয়ে যাচ্ছি। তবু যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ। দালাল চক্রের সঙ্গে কোনও ভাবেই আপস করব না।’’