চৌরঙ্গি
কাজের দিনে শহরের প্রাণকেন্দ্রে সমাবেশ হলে যা হওয়ার কথা, তা-ই হল। পথ আটকে সমাবেশ-মিছিলে সপ্তাহের দ্বিতীয় দিনেও ভোগান্তি চলল শহরবাসীর। রাস্তা থেকে প্রায় উধাও হয়ে গেল বাস-ট্যাক্সি-অটোর মতো যাত্রী পরিষেবা। পাতাল রেলও চলল ঢিমেতালে। গন্তব্যে পৌঁছতে নাজেহাল হলেন আমজনতা। যানজটে অ্যাম্বুল্যান্স আটকে যাওয়ায় ভুগতে হয় হাসপাতালমুখী অসুস্থ রোগীদেরও। এমনকী গুগ্ল ম্যাপের ট্রাফিক তথ্যেও দুপুরের দিকে শহরের বিভিন্ন রাস্তা দেখাল ‘লাল’ রঙে। যার অর্থ রাস্তা অবরুদ্ধ বা শ্লথগতি।
মঙ্গলবার বাস, ট্যাক্সি, অটো যে তেমন রাস্তায় নামবে না, তা জানাই ছিল। সেগুলির কিছু তৃণমূলের সভায় লোক নিয়ে যাবে এবং কিছু যে যানজটের ভয়ে চলবে না, তা ধরেই নেন শহরবাসী। তাই বেশির ভাগ অফিসযাত্রীই ভরসা করেছিলেন মেট্রোর উপরে। সেই পাতাল রেলও শুধুই ভোগান্তি বাড়াল।
ধর্মতলায় তৃণমূলের সভার জন্য এ দিন যে মেট্রোয় ভিড় উপচে পড়বে, তা জেনেও কর্তৃপক্ষ কেন আপৎকালীন কোনও ব্যবস্থা নিলেন না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন যাত্রীরা। মেট্রো জানাচ্ছে, সকাল পৌনে ১০টা নাগাদ ভিড় যখন সবে বাড়ছে, তখন শহিদ ক্ষুদিরাম স্টেশনে ব্রেক আটকে দাঁড়িয়ে পড়ে একটি এসি রেক। যাত্রীদের নামিয়ে সেটি ফেরত পাঠানো হয় কবি সুভাষের কারশেডে। তাতেই আপ লাইনে ট্রেন চলাচলে দেরি হয়ে যায় প্রায় ১৫ মিনিট। যার জের গোটা দিনে কাটিয়ে উঠতে পারেনি মেট্রো। ভিড় যত বেড়েছে, ততই পিছিয়েছে সময়। সঙ্গে হাসফাঁস ভিড়। শহিদ ক্ষুদিরাম ১০টা ২২ মিনিটে যে ট্রেনটি ছাড়ে, তা গীতাঞ্জলিতে চার মিনিট, সূর্য সেনে চার মিনিট, নেতাজিতে চার মিনিট এবং নেতাজি এবং উত্তমকুমারের মাঝে যে কেন দাঁড়িয়ে রইল, যাত্রীরা তার ব্যাখ্যা পাননি কর্তৃপক্ষের কাছে। এক-একটি স্টেশনে দাঁড়িয়ে থেকে বরং আতঙ্ক গ্রাস করেছে মানুষকে। মেট্রো মাঝপথে খারাপ হলে কী হবে, তা-ই ছিল একমাত্র আলোচ্য বিষয়।
ক দিকে সভামুখী সমর্থক, অন্য দিকে রাস্তায় বাস-অটো না পাওয়া অফিসযাত্রী। দুয়ে মিলে মেট্রোর বিভিন্ন স্টেশনে ভিড়় বাড়তে থাকে। তার মধ্যেই ১১টার পর থেকে বিভ্রাট। ভিড়ের চাপে এক সময়ে স্টেশনগুলিতে দাঁড়ানোরও জায়গা ছিল না। বন্ধ হচ্ছিল না অনেক ট্রেনের দরজা। দুপুর একটা নাগাদ মেট্রোর একটি কামরায় উঠে দেখা যায়, সেখানে চটি ডাঁই হয়ে পড়ে। ভিড়ের চাপে সেগুলি যাত্রীদের পা থেকে খুলে গিয়েছে বলেই মত কর্তৃপক্ষের। একটা সময়ে আরপিএফ জওয়ানদের লাঠি উঁচিয়ে ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতেও দেখা গিয়েছে। মেট্রো সূত্রে খবর, বিকেল ৫টা পর্যন্ত মেট্রোয় যাত্রীর সংখ্যা পাঁচ লক্ষ। অন্য দিনের তুলনায় যা এক লক্ষ লোক বেশি। তবে নিত্যযাত্রীদের মন্তব্য, বিভ্রাট এড়িয়ে সময় মতো ট্রেন চালালেই আর ভোগান্তি হতো না।
শহরের কেন্দ্রস্থলে সমাবেশ। ফলে প্রথমে জওহরলাল নেহরু রোডে এবং চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে উত্তরমুখী যানচলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। বেলা ১১টার পরে বিভিন্ন এলাকা থেকে ছোট বড় মিছিল আসতে শুরু করলে বন্ধ হয়ে যায় এসএন ব্যানার্জি রোড, লেনিন সরণি, জওহরলাল নেহরু রোড, এজেসি বসু রোড, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট, রেড রোডের একাংশ, নির্মলচন্দ্র দে স্ট্রিট, এসপ্ল্যানেড ইস্ট, এপিসি রায় রোড, গণেশ অ্যাভিনিউ, স্ট্র্যান্ড রোডের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা। বিকেলে ভবানীপুরে কংগ্রেসের মিছিলের জেরে যানজট হয় কালীঘাট, হাজরা মোড়-সহ বিভিন্ন রাস্তায়। সোমবারই লালবাজারের শীর্ষ কর্তারা জানিয়েছিলেন, সমাবেশের জন্য মানুষের ভোগান্তি এড়াতে মঙ্গলবার সকাল থেকে মোতায়েন থাকবে হাজার পনেরো পুলিশ। কিন্তু সেই তৎপরতাও কাজে এল না।
সমাবেশের জন্য সোমবারই শহরবাসীর কাছে আগাম ক্ষমা চেয়ে নেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে এনআরএসে যাওয়ার পথে অ্যাম্বুল্যান্সেই মৌলালিতে আটকে থাকা মাকে তা রেহাই দিতে পারেনি। গরমে অ্যাম্বুল্যান্সের দরজা খুলেও স্বস্তি পাননি তাঁরা। পরে অবশ্য পুলিশ অ্যাম্বুল্যান্সটিকে মিছিলের মধ্যে থেকে বার করে দেয়। দুপুরে এক্সাইড মোড়ের কাছে আড়াই বছরের অসুস্থ মেয়ে আরাধ্যাকে নিয়ে ট্যাক্সিতে বসে ছিলেন বারুইপুরের কেয়া রায়। যানজটে দীর্ঘক্ষণ আটকে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে শিশুটি। এসএসকেএমে প্রাথমিক শুশ্রুষার পরে ভারপ্রাপ্ত পুলিশ আধিকারিক গৌতম কর্মকার তাঁদের হাওড়ার দানেশ শেখ লেনের বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন।
এ দিন ছুটি ঘোষণা করে শহরের অনেক স্কুল। কিছু স্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি দিয়ে দেয়। তবে অফিসযাত্রীদের পথে নামতেই হয়েছিল। অতীত অভিজ্ঞতায় অনেকে যে ভাবেই হোক পৌঁছতে চেয়েছেন কাছের মেট্রো স্টেশনে। কিন্তু সেখানই বা পৌঁছবেন কী করে? প্রথমে গোল বাধে বাস-অটো-ট্যাক্সি না থাকায়। অভিযোগ, সমাবেশে যেতে জন্য যাত্রিবাহী ওই পরিবহণ তুলে নেন শাসকদলের নেতারা। সরকারি বাস রাস্তায় নামলেও ছিল হাতেগোনা।
এই দুরবস্থার জন্য শাসক দলকেই কাঠগড়ায় তুলেছেন বেসরকারি বাসমালিকেরা। তাঁদের সংগঠনের এক নেতা জানান, প্রতিদিন চলা বাসের ৯০ শতাংশই সমাবেশে লোক আনতে ব্যবহৃত হয়েছে। ফলে শুধু ডালহৌসি নয়, ভোগান্তি ছড়ায় শহর জুড়েই। সংগঠনগুলির দাবি, রাস্তায় প্রবল যানজটও বাস না চলতে পারার একটি কারণ। জয়েন্ট কাউন্সিল অব বাস সিন্ডিকেট্স-এর সম্পাদক তপন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘যত বাস পথে নামে, সেগুলি যানজটের জেরে সব রুটে চলেনি।’’ বেঙ্গল বাস সিন্ডিকেটের সম্পাদক দীপক সরকারও জানান, রাস্তায় বাস না চলায় ভোগান্তি বাড়ে। পরোক্ষে সমাবেশকেই কাঠগড়ায় তোলেন তাঁরা।
একই হাল সরকারি বাসেরও। কলকাতায় মূলত সিএসটিসি বাসই বেশি। এ দিন তারও আকাল ছিল। যেগুলি বেরোয়, যানজটের কারণে রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল বলে দাবি নিগমের। তাদের মতে, তাই বেশি বাস নামিয়েও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যেত না। তবে নিগমেরই অন্দরের খবর, বেশি বাস থেকেও রাস্তায় নামানো হয়নি, এ তথ্য ঠিক নয়। শাসক দলের সমাবেশে সরকারি বাসও ব্যবহার করা হয়েছে বলে দাবি এক কর্তার। সিটিসি-র বেশিরভাগ বাস রাস্তায় চললেও সেগুলি চলে মূলত শহরতলিতে। তাই কলকাতায় তার বিশেষ সুফল মেলেনি। এ দিকে, ট্যাক্সি এবং অটো ইউনিয়নগুলি সূত্রে খবর, চালকদের ৯০ শতাংশকেই যেতে হয়েছিল ধর্মতলার সভায়। অন্যথায় তাঁদের সাত দিন বসিয়ে রাখার হুমকিও দেওয়া হয় বলে খবর। তৃণমূলের শ্রমিক নেতাদের অবশ্য পাল্টা দাবি, অটো ও ট্যাক্সিচালকদের অনেকে স্বেচ্ছায় সভায় গিয়েছেন।
লালবাজার সূত্রের খবর, এ দিন রাস্তায় অন্য দিনের তুলনায় গাড়ি কম থাকায় সামলাতে বেশি বেগ পেতে হয়নি। কিছু রাস্তায় যানচলাচল নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল অল্প সময়ের জন্য। এক ট্রাফিক কর্তা বলেন, ‘‘দুপুরে এক-দেড় ঘণ্টার জন্য কিছু কিছু এলাকায় যান নিয়ন্ত্রণ করা হয়।’’ তিনটেয় সভা শেষ হওয়ার ঘণ্টা দুই পরেই অবশ্য ছবিটা পুরো পাল্টে যায়। বাস-ট্যাক্সি না থাকায় রাস্তাঘাট ছিল সুনসান। যেন ছুটির বিকেল।
ছবি: সুমন বল্লভ, দীপঙ্কর মজুমদার ও শশাঙ্ক মণ্ডল