কড়ি ফেললেই দ্রুত সুযোগ, প্রশ্নে তৎকাল চিকিৎসা

এক কার্ডিওলজিস্টের কাছে অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাওয়া হয়েছিল জুলাই মাসে। তিনি অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেন সেপ্টেম্বরে। ফোন করে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারীকে জানানো হয়— রোগীর অবস্থা গুরুতর, অত দিন অপেক্ষা করা যাবে না।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায় ও পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০১৬ ০০:৪৭
Share:

এক কার্ডিওলজিস্টের কাছে অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাওয়া হয়েছিল জুলাই মাসে। তিনি অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেন সেপ্টেম্বরে। ফোন করে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারীকে জানানো হয়— রোগীর অবস্থা গুরুতর, অত দিন অপেক্ষা করা যাবে না। চেম্বারে গিয়েও বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারবেন না রোগী। তখনই ‘ভিতরের খবর’ দেন সহকারী। জানান, সল্টলেকের চেম্বারে দ্বিগুণ ফি দিলে এক সপ্তাহের মধ্যেই মিলবে অ্যাপয়েন্টমেন্ট। সেখানে চেম্বারে দীর্ঘ অপেক্ষার যন্ত্রণাও সইতে হবে না।

Advertisement

মেডিসিন-এর এক ডাক্তারকে বহু বছর ধরেই দেখান এক রোগিণী। হঠাৎই ওই বৃদ্ধার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে বাড়ির লোকেরা ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁদের বলা হয়, ১০ দিনের আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট মিলবে না। প্রয়োজনটা গুরুতর জানানোয় প্রস্তাব দেওয়া হয়, নির্ধারিত ৫০০ টাকা ফি-এর বদলে ১৫০০ টাকা দিলে সে দিনই দেখানোর সুযোগ মিলবে। তাতেই রাজি হন তাঁরা। শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যা থেকে বাগবাজারের এক নার্সিংহোমে, তাঁর চেম্বারে ঠায় অপেক্ষা করে রাত সওয়া ১২টায় দেখানোর সুযোগ মেলে।

দেশের অন্যান্য বড় শহরের মতো কলকাতাও এখন নাম লিখিয়েছে চিকিৎসা পরিষেবার এই নয়া ফর্মুলায়— যার পোশাকি নাম ‘তৎকাল’। ঠিক যেমন ট্রেনের টিকিট শেষ মুহূর্তে পেতে তৎকালে বেশি টাকা খরচ করে কাটা হয়। তবে সে ক্ষেত্রে নৈতিকতার প্রশ্ন ওঠে না, যা উঠেছে এই চিকিৎসা পরিষেবার ক্ষেত্রে।

Advertisement

কিন্তু নৈতিকতার প্রশ্নের পাশাপাশি অনেকে এ-ও বলছেন, চিকিৎসকেরা যেহেতু এখন ক্রেতা সুরক্ষা আইনের আওতায় আসছেন, তখন চিকিৎসাকে তো পণ্য হিসেবে গণ্য করাই হচ্ছে। তা হলে অর্থনীতির শর্ত মেনে বেশি টাকায় দ্রুত পরিষেবার ব্যবস্থা করতে অসুবিধা কোথায়? ট্রেনের তৎকালের ক্ষেত্রেও তো স্রেফ বেড়াতে যাওয়ার জন্য এক জন বেশি টাকা দিয়ে টিকিট বুক করে ফেললেন বলে জরুরি চিকিৎসার কারণে যাওয়া প্রয়োজন এমন কেউ সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। ফলে নৈতিকতার প্রশ্ন তো সে ক্ষেত্রেও উঠতে পারে।

দক্ষিণ কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে চেম্বারে বসেন ফিজিক্যাল মেডিসিন-এর এক চিকিৎসক। দীর্ঘদিন তিনিও তৎকাল-ফি নিয়ে রোগী দেখছিলেন। তা নিয়ে অভিযোগ ওঠায় শেষ পর্যন্ত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের চাপেই সেই ব্যবস্থা বন্ধ করতে বাধ্য হন। তাঁর কথায়, ‘‘আমি এখনও মনে করি, ওই ব্যবস্থাটা থাকা দরকার। অবাঙালি রোগীরা তো এখনও আমাকে বলেন, বেশি টাকা দিতে অসুবিধা নেই। শুধু তারিখটা তাড়াতাড়ি দরকার।’’

এটাকেই তুরুপের তাস করে কলকাতার বহু বেসরকারি হাসপাতাল অনলাইন অ্যাপয়েন্টমেন্ট চালু করেছে। সেখানে এক জন ডাক্তারের সাধারণ চেম্বারে যা ফি, তার দ্বিগুণ টাকা নিয়ে দ্রুত অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়া হয়। এমনকী অনেক ডায়েটিশিয়ানও এই পদ্ধতিতে রোগী দেখছেন। বেশি টাকায় অনলাইনে নামী ডাক্তারদের দ্রুত অ্যাপয়েন্টমেন্ট করিয়ে দেওয়ার ব্যবসা চালু করেছে অনেক বেসরকারি সংস্থাও। কলকাতায় পরিষেবা দেওয়া এ রকমই এক সংস্থার প্রধান নীরজ ঠাকুরের কথায়, ‘‘অনেক বেশি টাকা দিচ্ছেন বলে রোগীরাও এ ক্ষেত্রে আশা করেন ডাক্তারবাবুরা তাঁদের অনেক বেশি সময় দিয়ে, ধৈর্য্য ধরে দেখবেন। সেটা অনেক ডাক্তার করেনও।’’

এলগিন রোডে ইনস্টিটিউট রয়েছে এক নামী বন্ধ্যত্ব চিকিৎসকের। সেখানে আবার নিয়ম, এক বার ওই চিকিৎসক রোগী দেখার পরে আর কোনও প্রয়োজন হলে ইনস্টিটিউটে অন্য জুনিয়র চিকিৎসক এবং টেকনিশিয়ানদের দেখাতে হবে। আর যদি ওই চিকিৎসকেরই ফের দ্রুত অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে হয়, তা হলে গুনতে হবে অতিরিক্ত অনেকটা টাকা।

এই পদ্ধতি যথাযথ নয় বলে মনে করছেন প্রবীণ, নামী চিকিৎসকদের অনেকেই। মেডিসিন-এর চিকিৎসক সুকুমার মুখোপাধ্যায় যেমন সরাসরিই বলছেন, ‘‘এই ব্যবস্থাটা আমার পছন্দ নয়।’’ কার্ডিও-মেডিসিন-এর চিকিৎসক অরিজিৎ রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘ঘোষিত তৎকাল সার্ভিস চালু হলে তার অপব্যবহারের ভয়টাই বেশি থাকে। কারণ, যাঁরা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেন, তাঁরা তো ডাক্তার নন। তাই তাঁদের পক্ষে কার প্রয়োজন কতটা বেশি, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা কঠিন। আমার ক্ষেত্রে তেমন জরুরি প্রয়োজনের কথা কেউ বললে নিজে কথা বলে সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিই। ইমার্জেন্সি রোগীকে আমি ফেরাই না। তবে আমি এ জন্য কখনও কোনও বাড়তি টাকাও নিই না।’’

তবে এরই পাশাপাশি অনেকে এ-ও বলছেন যে, পরিস্থিতি যে ভাবে বদলাচ্ছে, তাতে ডাক্তারদেরও এ পথে না হেঁটেও উপায় নেই। কার্ডিওথোরাসিক সার্জন কুণাল সরকারের কথায় যেমন, ‘‘ডাক্তারদের ‘তৎকাল চার্জ’ নেওয়া হয়তো নৈতিক ভাবে উচিত নয়, কিন্তু না করেও থাকা যাচ্ছে না। বাণিজ্য-অর্থনীতির জগতে ডাক্তারদের পিঠও দেওয়ালে ঠেকে গিয়েছে।’’ ইউরোলজিস্ট শিবাজি বসু আবার বলেন, ‘‘আলাদা চেম্বারে এস্টাব্লিশমেন্ট কস্ট-এর জন্য কিছু বাড়তি টাকা নেওয়া যেতেই পারে। তবে সেই অঙ্কটা খুব বেশি না হওয়াই বাঞ্ছনীয়। আর পরিষেবার দিক থেকেও নীতিগত ভাবে হাসপাতালের চেম্বার আর নিজস্ব চেম্বারের মধ্যে ফারাক থাকা উচিত নয়।’’

উঠছে আর একটা প্রশ্নও। একই ডাক্তার কি দু’জায়গায় দু’রকম ফি নিতে পারেন? সে ক্ষেত্রে কি যেখানে তাঁর ফি তুলনায় বেশি, সেখানে তাঁর কাছে উন্নততর পরিষেবা আশা করবেন না রোগীরা? আর যেখানে তিনি কম টাকা নেন, সেখানে তুলনায় দায়সারা ভাবে দেখবেন?

শহরের এক কার্ডিওলজিস্ট ই এম বাইপাসের ধারের এক হাসপাতালের চেম্বারে ৭০০ টাকা নেন। সেখানে তাঁকে দেখাতে গিয়ে রোগীদের আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েও গড়ে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা মতো অপেক্ষা করতে হয়। নিজস্ব চেম্বারে তিনি ১১০০ টাকা নেন। সেখানে কিন্তু ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যেই রোগীরা তাঁকে দেখানোর সুযোগ পেয়ে যান। তাঁর কথায়, ‘‘আমি চেম্বারে বেশি টাকা নিই। কিছুটা ‘এস্টাব্লিশমেন্ট কস্ট’ হিসেবে। আর কিছুটা অপ্রয়োজনীয় ভিড় ঠেকাব বলে।’’

যুক্তি অনেক। পাল্টা যুক্তিও প্রচুর। তবে তার মাঝখান থেকেই চিকিৎসায় এই তৎকাল পরিষেবা দিব্যি ফুলেফেঁপে উঠছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন