সহসা আতঙ্ক। বৃহস্পতিবার, মল্লিকবাজারে। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
নতুন কেনা স্মার্টফোন হাতে রাস্তা পেরোচ্ছিলেন সুমাল্য দত্ত। পথ আটকে হাত পেতে দাঁড়াল আট-দশ বছরের তিনটি বাচ্চা। প্রত্যেকের কাঁধেই একটি করে বাঁদর ছানা। নানা রকম অঙ্গভঙ্গি করে পথচারীদের মনোরঞ্জনের চেষ্টা করছিল তারা। এমনিতেই পশুপাখি ভালবাসে সুমাল্য। তার উপরে এমন ‘মিষ্টি বাঁদরামো’ দেখে মনটা গলে গেল। পকেট থেকে টাকার ব্যাগ বার করতে গিয়েই বিপত্তি। অন্যমনস্কতার সুযোগে হাতের মোবাইল ধরে টান মারল এক বাঁদর ছানা। রাস্তায় ছিটকে পড়ে নতুন ফোন ভেঙে চৌচির। ততক্ষণে দৌড় লাগিয়েছে বাচ্চারা।
পার্ক সার্কাস যাচ্ছিলেন জয়িতা মিত্র। সিগন্যালে ট্যাক্সি দাঁড়াতেই জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল বছর দশেকের এক ছেলে। কাঁধে বসা ছোট্ট বাঁদর ছানাকে খাবার কিনে দেওয়ার অছিলায় করুণ মুখ করে চাইল দুটো টাকা। জয়িতা দেবী নারাজ। তবু একটানা ঘ্যানঘ্যান করছিল ছেলেটি। টানাটানি করছিল ব্যাগের হাতল ধরেও। বিরক্ত হয়ে ধমক দিতেই আচমকা বাঁদরটিকে জয়িতাদেবীর গায়ে ছেড়ে দিল সেই ছেলে। ভয়ে চিৎকার করে উঠে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেই হাতে বাঁদরছানার কামড়। ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই সিগন্যাল সবুজ। নিমেষে উধাও বাঁদর ও তার মালিক।
দু’টি ঘটনাই মল্লিকবাজার মোড়ে। বাঁদরছানা কাঁধে আট থেকে দশ বছরের এই বাচ্চাদের অত্যাচারে রোজই জেরবার হচ্ছেন পথচারী থেকে গাড়িতে বসা মানুষ। তবে মল্লিকবাজার এলাকা প্রধান আস্তানা হলেও এদের দেখা মেলে শহরের বিভিন্ন সিগন্যালে। গাড়ি দাঁড়িয়ে গেলেই এদের আবির্ভাব। টাকা দিলে ভাল, অন্যথায় গায়ে বাঁদর ছেড়ে দেওয়া ছাড়াও এরা পথচারীদের গায়ে নোংরা এবং থুতু ছিটিয়ে দেয় বলেও অভিযোগ।
মল্লিকবাজার এলাকার পথচারী এবং স্থানীয় দোকানদারেরা জানাচ্ছেন, এই বাচ্চারা ‘বাঁদরপট্টি’র বাসিন্দা। দশটা বাজতে না বাজতেই তারা রাস্তার মোড়ে ভিড় জমায়। তার পরেই শুরু হয়ে যায় দৌরাত্ম্য। ফুটপাথের উপরে ফুচকার দোকান আছে চঞ্চল প্রসাদের। তাঁর আরও অভিযোগ, এই সব বাচ্চারা মাঝে মাঝে চুরি করেও পালায়। কিছু বলেন না?
চঞ্চলবাবুর জবাব, ‘‘এমনিতে চেঁচামেচি করলে ওরা পালিয়ে যায়। তবে আমরাও বেশি কিছু বলি না। কে লাগতে যাবে বাঁদরপট্টির বাচ্চাদের সঙ্গে? বেশি বকাঝকা করলে আবার দল বেঁধে রুখে দাঁড়ায়।’’
মল্লিকবাজার মোড় থেকে পার্ক সার্কাস-মুখী রাস্তা ধরে মিনিট তিনেক হাঁটলেই বাঁ হাতে বাঁদরপট্টি। ছোট ছোট ঝুপড়ি, রাস্তার ধারেই রান্না হচ্ছে বিরিয়ানি। ইতস্তত আড্ডায় ব্যস্ত বিভিন্ন বয়সের মানুষ। আর প্রত্যেকটি আড্ডাতেই মধ্যমণি এক বা
একাধিক বাঁদর।
পুলিশের খাতায় এখন কলকাতার অন্যতম অবৈধ মাদকের ঠেক হিসেবে চিহ্নিত হলেও এক সময়ে ‘বান্দরওয়ালা’দের ভিড়ে রমরম করত বাঁদরপট্টি। তেমনই এক বান্দরওয়ালা করিম খান। তাঁর দুই পোষ্যের নাম সুলেমান আর ফতিমা। করিমের পূর্বপুরুষেরাও ভালুকের খেলা দেখাতেন। করিম আরও জানান, মূলত বিহারের গয়া, মুঙ্গের, ছাপরার মতো জেলাগুলি থেকে মানুষ এ রাজ্যে বাঁদর বা ভালুকের খেলা দেখাতে আসতেন। সেটাই ছিল তাঁদের জীবিকা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিষিদ্ধ হয়েছে ভালুকের খেলা, জনপ্রিয়তা কমেছে বান্দরওয়ালাদেরও। তলানিতে ঠেকেছে রোজগার। করিমের আক্ষেপ, তাই তাঁদের ছেলেমেয়েরা বেছে নিচ্ছে ভিক্ষাবৃত্তি, পরে জুটে যাচ্ছে অবৈধ মাদকের কারবারে।
কিন্তু দিনের পর দিন এই বাচ্চাদের দৌরাত্ম্যের বিষয়ে পুলিশে অভিযোগ জানিয়ে কোনও লাভ হয়নি বলে জানাচ্ছেন নিত্যযাত্রীরা। পুলিশের চোখের সামনেই অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে বাঁদরছানা কাঁধে বাচ্চাবাহিনী। আচমকা তাদের কান্ডকারখানায় ভয়ে চিৎকার করে উঠছেন পথচারী-নিত্যযাত্রীরা। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, আচমকা ভয় পাওয়া থেকে যে কোনও মুহূর্তেই ঘটে যেতে পারে বড় বিপদ। ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে হৃদ্যন্ত্রও। অন্তঃসত্ত্বাদের ক্ষেত্রে আচমকা এমন কিছু দেখে ভয় পাওয়া মা ও সন্তান উভয়ের পক্ষেই ক্ষতিকারক হতে পারে।
কিন্তু সব কিছু জেনেও পুলিশ চুপ কেন?
স্থানীয় এক ব্যবসায়ীর কথায়, ‘‘পুলিশ কিছু বলবে না। বাঁদরপট্টির সঙ্গে অনেক রকম বোঝাপড়া আছে।’’ জবাবে কী বলছে পুলিশ? বেনিয়াপুকুর থানার এক অফিসার বলেন, ‘‘এ ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারব না। কিছু জানার থাকলে নিজে খুঁজে নিন।’’